বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, তাদের রাজনীতির একটা নির্দিষ্ট কাঠামো আছে; ধরন ও গতিপ্রকৃতি আছে। তাদের অধিকাংশকেই একটা ছাঁচে ফেলে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বড় ‘বেখাপ্পা’। তাকে সহজে কোনো ছাঁচে ফেলা যায় না। কোনো ইজমে ফেলে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। প্রথাগত রাজনৈতিক সংগঠনের কাঠামোর মধ্যে তাকে আঁটানো যায় না।

বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বাম ও ডান সবারই অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশের পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সবাই সংকটে তার ওপরই আস্থা রাখতে চাইতেন। তার দরগায় গিয়ে আঁছড়ে পড়তেন। তিনি সংগত সব জায়গায় হুংকার দিয়ে পড়তেন। কিন্তু কারো করতলগত হতেন না। এমন মানুষ ‘বেখাপ্পা’ ছাড়া আর কী!

পরতেন পাঞ্জাবি। ফ্যাশন না; সত্যি সত্যি। মানে নামাজ পড়তেন। পীর ছিলেন। মুরিদ ছিল তার। মাঝে মাঝে টাঙ্গাইলে ডুব দিতেন। চলে যেতেন জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বা কোনো অখ্যাত মুরিদের বাড়িতে। রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, সুলভ সংস্করণ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃষ্ঠা-২৫৫) আবার সময়মতো এসে হাজির হতেন; প্রয়োজনীয় সময়ে। তার হাজিরা মানে শুধু উপস্থিতি নয়; দুশমনের বিরুদ্ধে রীতিমতো বেয়াড়া তর্জনীর শাসানি, ভয়ডরহীন সিংহনাদ। এই গর্জন সবসময় আবশ্যিকভাবে জালিমের বিরুদ্ধে যাবে। এটা ছিল বান্ধা-সত্য। তিনি বেশিদিন কোনো রাজনীতিবিদের সাথে থাকতে পারেননি; তাকেও বেশিদিন কোনো রাজনীতিবিদ সহ্য করতে পারেননি। কারণ তিনি ‘বেখাপ্পা’।

মওলানা রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। আবার সময়মতো এসে হাজির হতেন; প্রয়োজনীয় সময়ে। তার হাজিরা মানে শুধু উপস্থিতি নয়...

শুরুতে তমদ্দুন মজলিশের লোকজন ভাসানীর গুণগান করতেন। কারণ তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কথা বলতেন। কিন্তু তিনি যখন ন্যাপ গঠন করলেন তারা খেপে উঠলেন। ন্যাপকে তারা বলতে শুরু করলেন ‘সুবিধাবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও কমিউনিস্টদের সংগঠন’। মওলানার সভা যখন ‘আওয়ামী লীগাররা ভেঙে দিয়েছে’ তখন তিনি ‘নাজেহাল’ হয়েছেন ভেবে তমুদ্দনিরা খুশি হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সাথে তার পথচলাও খুব একটা সুখের ছিল না। আওয়ামী লীগের মধ্যেও তার সম্পর্কে অনুযোগ কম ছিল না। অনেক অনুযোগের একটা ছিল এই যে, ভাসানীর মধ্যে ‘দরকারের সময় আত্মগোপনের মনোভাব’ ছিল আগাগোড়া। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, সুলভ সংস্করণ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃষ্ঠা-২৫৫) ভাসানীকে দলের চাহিদা ও কাঠামো মোতাবেক ঠিকমতো মেলানো যায় না বলে আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এও বলেছেন যে, ‘মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা কষ্টকর’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২৪৬) এর জের ধরেই ১৯৫৭ সালে ভাসানী প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সালে লেখা কারাগারের রোজনামচাতেও ভাসানী সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের খেদ ও অনুযোগ অত্যন্ত স্পষ্ট। (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৫৭, ৬৫, ১০০, ১০৪) এরকমই হওয়ার কথা। কারণ ভাসানী তখন (যখন কারাগারের রোজনামচা লেখা হয়েছে) আওয়ামী লীগের কেউ নন। তাছাড়া তিনি ওই সময় আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারেননি। অর্থাৎ ছয় দফা সমর্থন করেননি।

আওয়ামী লীগের ছয় দফা প্রচারিত হওয়ার পরপরই ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১৪ দফা কর্মসূচি পেশ করেছিল। তাদের কর্মসূচির শিরোনাম ছিল ‘১৪ দফা জাতীয় মুক্তির কর্মসূচি’। শুধু ছয় দফা নয়, তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনও চাননি। এই নির্বাচনের আগে তিনি স্লোগান তোলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাসে এই দুটি সিদ্ধান্তই ভাসানীর অদূরদর্শিতা বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এবং সেটা সাব্যস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, ছয় দফা এবং সত্তরের নির্বাচনই বাংলাদেশকে সম্ভব করে তুলেছে। তার মানে ইতিহাসের সহজ বয়ান দাঁড়িয়েছে যে, ভাসানী অন্তত এই দুই ব্যাপারে সঠিক ছিলেন না। তার প্রদর্শিত পথে হাঁটলে দেশ হয়তো স্বাধীনই হতো না বা হলেও কখন, কীভাবে হতো তা বলা মুশকিল।

মোদ্দাকথা, ভাসানী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম করা দল আওয়ামী লীগের সাথে যখন ছিলেন তখনো এবং পরে যখন আওয়ামী লীগের সাথে ছিলেন না তখনো ঠিকমতো মিলমিশ খাননি। মানে ভাসানী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের সব ইভেন্টের সাথে খাপ খাননি। কিন্তু ভাসানীর পক্ষ থেকে এসবের কী ব্যাখ্যা ছিল! তিনি কী চাইতেন!

তিনি বেশিদিন কোনো রাজনীতিবিদের সাথে থাকতে পারেননি; তাকেও বেশিদিন কোনো রাজনীতিবিদ সহ্য করতে পারেননি। কারণ তিনি ‘বেখাপ্পা’।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ধর্মভিত্তিক-সামন্ত রাজনীতি ও নিয়মতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাজনীতির উপর ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। একারণেই ভাসানী মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ কারো সাথেই আর খাপ খাওয়াতে পারেননি। তিনি চাইতেন রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সর্বহারা শ্রেণি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করবে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি এই শ্রেণিকে জাগাতে রাজনীতি করতেন। মন্ত্রী-এমপি হয়ে ক্ষমতার গদিতে বসা তার উদ্দেশ্য ছিল না। এজন্য তিনি ১৯৪৯ সালের পরে আর কখনো কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হননি। শুধু তাই নয়, ১৯৫৪ সালের পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনের ওপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কারণ তিনি দেখেছেন, নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন শুধু এক গোষ্ঠীকে সরিয়ে অন্য গোষ্ঠীকে ক্ষমতাবান করে। বুভুক্ষু মানুষের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয় না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় তিনি যে স্লোগান তুলেছিলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’, তার যথার্থতা প্রমাণের জন্য ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, “মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা, যে বিক্ষোভ মানুষের মনে আগ্নেয়গিরির মতো দানা বাঁধিয়াছিল- যার বিস্ফোরণ ঘটিলে এই দেশে আর একটি ফরাসি বিপ্লব ঘটিয়া যাইত। এই অবস্থায় এই দেশের সকল কায়েমি স্বার্থবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের উত্তরাধিকারী ধনী শোষকদের গড়া ইমারত, বালাখানা, তখত-তাউস ধূলিসাৎ হইয়া যাইত, বিলীন হইয়া যাইত, তাহাদের অবশিষ্ট চিহ্নটুকু ধরাপৃষ্ঠ হইতে মুছিয়া যাইত। সম্ভবত এই পরিণতির কথা আন্দাজ করিতে পারিয়া, উঠতি বুর্জোয়ারা, শাসন ক্ষমতার রাশ টানিয়া ধরিবার জন্য, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও আমার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করত কৃষক-মজুর, মেহনতি জনগণের সুতীব্র সংগ্রামকে, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামমুখী’ আন্দোলনকে সুকৌশলে নির্বাচনমুখী করিয়া দিবার জন্য, বিশেষ তৎপরতার সাথে তাহাদের গোপন হস্ত চালনা করিয়াছিল।” (মওলানা ভাসানীর রচনা, পলল প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা- ১২৫-১২৬)

ভাসানী সবসময় নির্বাচনের চেয়ে “কৃষক-মজুর, মেহনতি জনগণের সুতীব্র সংগ্রামকে, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামমুখী’ আন্দোলনকে” বেশি জরুরি মনে করতেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রের স্বভাব পরিবর্তন করতে চাইতেন। তা না করে ভোটের মাধ্যমে ‘প্রভুবদল’ হলে কী হয় তার প্রমাণ স্বয়ং বাংলাদেশ বলে ভাসানী আমৃত্যু মনে করতেন। ভোটের শুভংকরের ফাঁকি যিনি ধরে ফেলেন তিনি ‘বেখাপ্পা’ ছাড়া আর কী! তবে বাংলাদেশের ইতিহাসের ‘মহা বয়ানে’ স্বাধীনতার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচন জরুরি ছিল বলেই বর্ণিত হয়ে থাকে।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১-এ বাঙালির স্বপ্ন-সাধের বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই স্বাধীনতায় তুষ্ট হতে পারেননি ভাসানী। তিনি বলেছেন, ‘জনগণ মূল্য দিয়াছে ঠিকই’ কিন্তু তাদের ‘আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় নাই’। ‘কুশাসন আবার শুরু হইয়াছে’। তিনি বলেছেন, ‘আইয়ুব আমলের ৮০ হাজার ফেরেশতা লালনের ইন্সটিটিউশন ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিল, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ইত্যাদি।’ আর ‘স্বাধীন হইবার পর ৫ লাখেরও বেশি দানব গজাইয়াছে।’ তিনি বলেছেন, ‘বস্তুত পতাকা বদলের স্বাধীনতা ছাড়া এ স্বাধীনতা জনগণের জীবনের প্রান্তে অধিকতর দুঃখ ছাড়া আর কী দিতে পারিয়াছে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিধাতা আমলা শ্রেণি এবং ১৫ লাখ টাকার চরম নব্য শোষক শ্রেণির পদতলে বিসর্জন দেওয়া হইতেছে। ... সামন্ত শোষণ এখনো আছে।’ (মওলানা ভাসানীর রচনা, পলল প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১১৪)

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটু যেন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, তিনি সামন্তবাদ বিরোধী ছিলেন, ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ, বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে; কিন্তু তবু তাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলার উপায় নেই।’

এ তো গেল নির্বাচন আর বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে ভাসানীর মিলমিশ না খাওয়ার কথা। ঐতিহাসিকদের হিসাব-কেতাবের সাথেও তিনি ঠিক মেলেন না। তাকে বামপন্থীরা আদর করে ডাকতেন ‘লাল মওলানা’। কিন্তু ধর্মে তার মতি ছিল পুরোপুরি। এই ধর্মে মতি আবার বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীলতা’র সাথে খাপ খায় না। ফলে কারো কারো মতে তিনি আবার পুরোপুরি সমাজতন্ত্রীও হন না। যেমন, মওলানার চিন্তায় ইসলামের বা ধর্মের প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘তিনি এসেছেন পশ্চাৎপদ কৃষক পরিবার থেকে সেখানে ধর্মের প্রভাব শক্তিশালী। তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, উত্তর ভারতের দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় ছিলেন ১৯০৭-০৯, এই দুই বছর। তাকে পীরের কাজও করতে হয়েছে। সেজন্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়া তার জন্য কঠিন ছিল।’ (বাঙালির জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃষ্ঠা-২২০) চৌধুরী একটু যেন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, তিনি সামন্তবাদ বিরোধী ছিলেন, ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ, বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রে; কিন্তু তবু তাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলার উপায় নেই।’ (বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, পৃষ্ঠা-৩২৩) বলেছেন, ‘জনগণের মানুষ হয়েও মওলানা ভাসানী ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেননি।’ চৌধুরী বলতে চান, সবই ঠিক ছিল খালি ধর্মটা ...!

সব মিলিয়ে দেখা গেল, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে অধিকাংশই খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। মানে তিনি কোনো ব্যাকরণের মধ্যে পড়েননি। আসলে ভাসানী মাঠের মানুষ, মাটির মানুষ; তত্ত্বের মানুষ নন। এজন্য কোনো রাজনৈতিক তত্ত্ব বা কাঠামো দিয়ে তাকে ধরা যায় না। তবে কি ভাসানী নিজেই একটা তত্ত্ব হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন বা তত্ত্বের আভাস দিয়ে গিয়েছেন, যে তত্ত্বে বা রাজনীতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো প্রবেশ করেনি! একারণেই কি ভাসানীর দুঃখী মুখের দীর্ঘশ্বাসে আর্দ্র হয়ে আছে বাংলার মাঠ ঘাট রাজপথ ময়দান!

ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
kudratehuda@gmail.com