গণতন্ত্রের ভিত্তি বহুমাত্রিক। শুধু রাজনৈতিক উৎপাদন নয়, এর অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, আরও সহজে বললে, ভোটের নিশ্চয়তার জন্য দেশের মানুষ কয়েক যুগ ধরে বুকের রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পাড় করতে চললেও আজও আমরা মানুষের সেই ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা অর্জন করতে পারিনি, দিতে পারিনি। বিভিন্ন সময় নানাভাবে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। এক সময় ভোটও হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকাকে ‘আইনসংগত’ করা হয়েছে। কিন্তু সবসময় মানুষ ইচ্ছামত তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।

বিগত দিনের সব নির্বাচন হিসেবে রেখে গত দুইটি নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ভোটের কোনো পরিবেশ ছিল না। ক্রিয়াশীল অধিকাংশ দল এই ভোটে অংশ নেয়নি। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট? অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে অধিকাংশ জায়গায় দিনের ভোট ‘আগের রাতে’ সম্পন্ন হওয়ার নতুন রেকর্ড দেখল দেশবাসী, বিশ্ববাসী। অথচ গঠিত হয়ে গেল সরকার। এই নির্বাচন ও পরবর্তী নির্বাচনী ঘটনাবলিতে মানুষ, চলতি নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃত নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ চলে গেছে নির্বাসনে।

নির্বাচনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ‘টাকার খেলা’, ‘পেশি শক্তির প্রতিযোগিতা’, ‘সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক প্রচার-প্রচারণায় আবদ্ধ করা’ ও ‘প্রশাসনিক কারসাজি’র খেলায় পরিণত করেছে। এর জন্য নতুন নতুন কৌশল(!) কাজে লাগাচ্ছে।

দেশের নানা সংকটের মধ্যেও সরকার ‘উচ্চস্বরে’ তাদের ক্ষমতায় থাকার এক যুগ পালন করছে। দেশের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ জাতীয় সংসদকে সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইনপ্রণয়ন-ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের’ মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচনের কথাও বলা আছে। অর্থাৎ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মধ্য দিয়ে তো সরকার নির্বাচিত হওয়ার কথা। দেশের একজন সাধারণ মানুষ তিনি তো ভোটের অধিকারের অপেক্ষায় থাকেন। অন্য অনেক কিছু বঞ্চিত মানুষের কাছে ভোটাধিকার প্রয়োগ হয় গৌরবেরও। তাই এ সময়েও জনগণকে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নিজেদের পছন্দমত সরকার গঠনের অধিকারের কথাও ‘উচ্চস্বরে’ বলাতে হবে। একই সাথে ভোটের যথাযথ প্রয়োগ বিবেচনায় নিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারও করতে সচেতন প্রয়াস নিতে হবে।

‘রাজনৈতিক গণতন্ত্রের’ অন্যতম উপাদান হল নির্বাচন। নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ না হলে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রেও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। সর্বত্র জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নেওয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং এজন্য একটি উপযুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা ও তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি কর্তব্য। শাসকরা নির্বাচনের কথা এলে নিজেদের সুবিধামত সর্বোচ্চ ‘ভোট দেওয়া’র কথাকে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। ভোট দেওয়ার অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলনের সাথে সাথে ভোটে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিটি নাগরিকের সম সুযোগ পাওয়াসহ পূর্বপর অধিকারের কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি।

আমরা দেখে আসছি, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের দলীয় স্বার্থে নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করতে মোটেই দ্বিধা করে না। নানা ধরনের ‘কু-যুক্তি’ দিয়ে একে সঠিক করার চেষ্টা করে। এরা নির্বাচনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ‘টাকার খেলা’, ‘পেশি শক্তির প্রতিযোগিতা’, ‘সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক প্রচার-প্রচারণায় আবদ্ধ করা’ ও ‘প্রশাসনিক কারসাজি’র খেলায় পরিণত করেছে। এর জন্য নতুন নতুন কৌশল(!) কাজে লাগাচ্ছে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য জনগণের উপর নয় দেশি-বিদেশি নানা শক্তির উপর নির্ভরশীলতা শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে না পারলে, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, মধ্যবিত্ত, স্বল্পবিত্তদের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষ থাকবে উপেক্ষিত। নির্বাচনের নামে কোটিপতিদের ‘অর্থ-প্রশাসনিক কারসাজি-পেশি প্রদর্শন-সাম্প্রদায়িকতা আর আঞ্চলিকতার’ উৎসবের প্রদর্শনী চলতে থাকবে। ভোট ব্যবস্থা যাবে আরও নির্বাসনে।

চলতি ধারার শাসকরা নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। আর নির্বাচন কমিশন? সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) অবাধ-নিরপেক্ষ, অর্থবহ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থার অমূল পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ‘নির্বাচনী আইন সংস্কারের’ জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পরবর্তীতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে আলোচনা-মতবিনিময় করে। সিপিবি ঐ সময়েও শুধু নির্বাচনী আইনের সংস্কার নয়, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের’ জন্য কতক প্রস্তাব দিয়েছিল। এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করেছিল।

চলতি ধারার শাসকরা নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। আর নির্বাচন কমিশন? সরকারের আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবে না। এ অবস্থা থেকে তাই ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থাসহ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

শুধু জাতীয় সংসদ নয়, স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করা এবং সাংসদকে স্থানীয় সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রয়োজনে এজন্য আইন সুনির্দিষ্ট ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

নির্বাচনকে ‘টাকার খেলা-পেশি শক্তি-সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিকতা-প্রশাসনিক কারসাজি’ মুক্ত করতে হবে। নির্বাচনে সকল প্রার্থীর প্রচার প্রচারণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে, সম সুযোগ দিতে হবে। তার আগে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন যেন কাজ করে, এমন নির্বাচন কমিশন গঠন ও প্রশাসনিক সকল হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

জনগণের সচেতনতা, সংগঠিত শক্তি সমাবেশই পারে শাসকগোষ্ঠীকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে বাধ্য করে অন্তত জনগণের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স ।। সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

hossainprince@yahoo.com