মুরাদ হাসানের কানাডা গমনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার শুরুতেই দেখা যাক কানাডার সিটিজেন, পিআর বা ফরেন ন্যাশনাল বলতে কী বোঝায়? সাধারণভাবে একজন ব্যক্তি কানাডার নাগরিক বা সিটিজেন, যদি—

- তার জন্ম কানাডায় হয়। ব্যতিক্রম, বিদেশি কূটনীতিকের ক্ষেত্রে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির পিতামাতার কমপক্ষে একজন কানাডিয়ান নাগরিক (সিটিজেন) বা স্থায়ী বাসিন্দা (পিআর) হতে হবে; অন্যথায়, কানাডায় জন্ম নেওয়া ব্যক্তিটি কানাডিয়ান নাগরিক বিবেচিত হবেন না।

- তিনি কানাডায় প্রাকৃতিকীকরণ (ন্যাচারাইজেশন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিক হয়েছিলেন; অর্থাৎ, নাগরিক হওয়ার আগে তিনি কানাডার পিআর ছিলেন।

- তিনি কানাডার বাইরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার পিতামাতার একজন হয় কানাডায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বা তার জন্মের আগেই কানাডায় ন্যাচারালাইজড হয়েছিলেন। (এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি কানাডার বাইরে জন্মগ্রহণকারী ‘প্রথম প্রজন্ম কানাডিয়ান’ বলে গণ্য হবেন।)

- কানাডার ইমিগ্রেশন আইনে এ সংক্রান্ত আরও কয়েকটি ধারা আছে যা এ লেখায় অন্তর্ভুক্ত করা নিষ্প্রয়োজন।

এবার জেনে নিই কানাডার আইনানুযায়ী কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা বা পিআর হতে একজন ব্যক্তিকে কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়? সেই ব্যক্তিই কানাডার পিআর, যিনি—

- কানাডায় অভিবাসন করে স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা পেয়েছেন, কিন্তু, এখনো কানাডার নাগরিক হননি বা হতে পারেননি। (স্থায়ী বাসিন্দারা অন্য এক বা একাধিক দেশের নাগরিক হতে পারেন, কানাডার নন।)

- কানাডায় অস্থায়ীভাবে, যেমন, একজন ছাত্র বা বিদেশি ওয়ার্কার/কর্মী’র মতো বসবাস করেন না।

- সরকারি বা প্রাইভেট কোনো শরণার্থী প্রোগ্রামের পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যদেশ থেকে পুনর্বাসিত হয়ে কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। কেউ কানাডায় শরণার্থী দাবি (রিফিউজি ক্লেইম) করলেই সাথে সাথে তিনি কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান না; এর একটা দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া আছে।

- অতীতে কানাডার পিআর স্ট্যাটাস পেয়েছিলেন এবং এখনো তা বলবৎ আছে। (কানাডার পিআর স্ট্যাটাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় না।)

ফরেন ন্যাশনাল—

- যিনি কানাডার সিটিজেন বা পিআর নন তিনি কানাডায় একজন ‘ফরেন ন্যাশনাল’ বা বিদেশি নাগরিক গণ্য হবেন।

যেহেতু মুরাদ হাসান কানাডার সিটিজেন বলে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই, তাই এ আলোচনার প্রয়োজনে তাকে কানাডার একজন পিআর বা ফরেন ন্যাশনাল ধরে নেওয়া যেতে পারে।

একজন ব্যক্তি তার কানাডায় ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস যাই হোক, তাকে কানাডায় প্রবেশের সময় কানাডার পয়েন্ট অব এন্ট্রি’তে ‘এক্সামিনেশন’ করা হয়। এক্সামিনেশন মানে জিজ্ঞাসাবাদ। কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি (সিবিএসএ) এই এক্সামিনেশন করে থাকে। কানাডার নাগরিক বাদে অন্যরা সিবিএসএ’কে সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সিবিএসএ কানাডায় প্রবেশে ইচ্ছুক ব্যক্তির কানাডা প্রবেশ আটকে দিতে পারে বা প্রয়োজনবোধে তাকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

সিবিএসএ প্রধানত, কানাডায় প্রবেশ করতে আগ্রহী ব্যক্তির ইনএডমিজিবিলিটি (অপ্রবেশযোগ্যতা) পরীক্ষা করে দেখে। কোনো ফরেন ন্যাশনাল বা পিআর বিভিন্ন কারণে কানাডায় প্রবেশের অনুপযোগী বিবেচিত হতে পারেন; যেমন,

- তিনি যদি কানাডার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বিবেচিত হন।

- তিনি যদি সহিংসতার কাজে জড়িত হওয়া যা কানাডার জনগণের জীবন বা নিরাপত্তাকে বিপন্ন করতে পারে এমন কিছু ঘটানোর মতো কেউ সম্ভাবনাময় ব্যক্তি বিবেচিত হন।

মুরাদ হাসানের ব্যাপারে যে অডিও কেলেঙ্কারি গণমাধ্যমে এসেছে তা সত্য ধরে নিলে তাকে উপরের দুই কারণে অভিযুক্ত করা যায়। বাংলাদেশের এক চিত্রনায়িকাকে তিনি যেভাবে হুমকি দিয়েছেন বলে জানা গেছে তা যেহেতু ওই চিত্রনায়িকার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক, একই কারণে তা যেকোনো কানাডিয়ান নাগরিকের জন্যও বিপজ্জনক গণ্য করা যায়। তাছাড়া, যৌনক্রিয়ার আহবানে ওই নারীর অসম্মতিও ফোনালাপে স্পষ্ট। তাই, এটি সম্ভাব্য ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে, যা সহিংসতা। তাকে কানাডায় প্রবেশের সুযোগ দিলে অনুরূপ যৌনসহিংসতা কানাডার জনগণের জীবন বা নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। অন্য একটি অডিওতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর এক নাতনির বিষয়ে ‘ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সাথে যৌনক্রিয়া করছেন’ মর্মে মুরাদ যেভাবে সমালোচনা করেছেন তাতে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতি তার বিদ্বেষ প্রকাশ পায়।

কানাডা একটি বহু সংস্কৃতির দেশ। ফলে, এমন ব্যক্তি কানাডায় প্রবেশ করা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যও বিপজ্জনক। অডিও রেকর্ড সত্য ধরে নিলে এগুলোর সবকটিই গুরুতর অভিযোগ। এসব বিবেচনায় মুরাদ হাসান কানাডায় ইনএডমিজিবল বা অপ্রবেশযোগ্য বিবেচিত না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।

কিছু গণমাধ্যমে দেখলাম, সিবিএসএ নাকি মুরাদকে জানিয়েছে যে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কানাডিয়ান নাগরিক কানাডায় তার প্রবেশে আপত্তি জানিয়েছেন, যে কারণে তাকে কানাডায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমার জানামতে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া (ইনএডমিজিবিলিটি বুঝানো হচ্ছে) সিবিএসএ কারো কানাডা প্রবেশে বাধা দিতে পারেন এমন কোনো আইনি ধারা বা উপধারা কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট বা রেগুলেশনে নেই।

এছাড়া, কেউ কেউ বলছেন মুরাদ হাসান কানাডায় বাড়ি কিনেছেন এবং বর্তমান দুঃসময়ে তার সে বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছেন। এটি সম্ভব হতো তিনি যদি কানাডার সিটিজেন হতেন। পোর্ট অব এন্ট্রিতে আসার পর সিবিএসএ কর্তৃক কানাডায় ইনএডমিজিবল সাব্যস্ত হলে একজন পিআর বা ফরেন ন্যাশনালকে কানাডায় ঢুকতে দেওয়া হবে না, এটাই নিয়ম। কানাডায় আত্মীয়স্বজন বা বাড়িঘর আছে কি না, এমনকি কানাডায় পিআর স্ট্যাটাস আছে কি না তা এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়।

একজন কানাডীয় ইমিগ্রেশন পরামর্শক (আরসিআইসি) হিসেবে দেশবাসীকে দীর্ঘদিন যাবৎ সেবা প্রদান এবং কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করি বলে দেশ-বিদেশের অনেকেই মুরাদের বিষয়টি নিয়ে আমাকে নানা প্রশ্ন করে চলেছেন। আজ সকালেও দেশ হতে একটি গ্ৰুপ এ বিষয়ে অনলাইন আলোচনায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানায় যা আমি সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি। এসব প্রশ্ন বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের এই প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রীর কানাডায় আগমন বিষয়ে কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট ও রেগুলেশনের ভিত্তিতে একটি নির্মোহ আলোচনার প্রয়াস চালিয়েছি কেবল; এ লেখার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই।

এম এল গনি ।। কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট