বাংলাদেশ যখন বিজয়ের পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে, তখন নিজের মনের রক্তাক্ত আঙিনায় আবারও আবেগের ঢেউ ওঠে। যাচাই করি, অর্জন আর বিসর্জনের বাটখারায় দেখি কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথযাত্রাকে নতুন করে আরও একবার। নিজের মনের আয়নার সামনে দাঁড়াই।

পঞ্চাশ বছর পূর্বে, এই দিনগুলোতে চলছে মুক্তির যুদ্ধ। চলছে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, কত সহস্র মা-বোন পাকিস্তানি ক্যাম্পে নির্যাতিত হচ্ছে—তবুও মানুষ স্বাধীনতার প্রশ্নে অটল।

ডিসেম্বর আসলেই সারাক্ষণ সেই নির্যাতনের অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভুগতে থাকি। কত কষ্টে, কত ত্যাগে, কত দামে অর্জিত এ বাংলা! নতুন প্রজন্ম কি তার মর্যাদা বোঝে? অনুধাবন করতে পারে কি সেই সাহসের ব্যাপ্তি? তাদের বুকেও কি ঝড় ওঠে নির্যাতিত পূর্ব প্রজন্মের জন্য?

সহস্র বছরের ইতিহাসে বাঙালি কখনো নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভোগ করেনি। সমৃদ্ধ এ জাতির সম্পদের লোভে বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয়েছে এ জনপদের অধিবাসী। তবে বাঙালি কখনোই নীরবে তা মেনে নেয়নি। বিদ্রোহ করেছে, শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন–সংগ্রাম করেছে।

বারবার শতবর্ষ ধরে, তাই বাঙালি দেশমাতৃকার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে এসেছে। সহস্র বছরের পরাধীনতার পরে, অবশেষে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে বাঙালি পেল সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা—আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে।

স্বাধীন দেশে প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে হৃদ্যতা ও ভালোবাসায় জড়িয়ে শান্তিতে বসবাস করার কথা ছিল। উল্টো, যে নেতার হাত ধরে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনল বাঙালি, তার বুকে গুলি ছুড়ে হত্যা করে পিতৃহন্তারক পরিচয়ের কলঙ্কের তিলক পড়ল কপালে। সেই সাথে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সকল আদর্শিক অর্জনকে ভূপতিত করে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল এদেশ।

মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের মানবতাবোধ নষ্ট করে সমাজকে অসহনশীল, স্বার্থপর করে তুলছে। মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

সহস্র বছরের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে যে জাতিসত্তায় গড়ে উঠেছে এই জনপদের অধিবাসী, সেই বাঙালি পরিচয়কে রাতারাতি পাল্টিয়ে পাকিস্তানি আদলে তৈরি করা হলো ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। জাতিসত্তার সাথে গুলিয়ে ফেলল নাগরিকত্ব।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত দিয়ে যেই আদর্শিক অবস্থানে নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছে বাঙালি, সেই চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা—সংবিধানে স্পষ্ট করা লেখা ছিল। সেই সংবিধানকে কাটা ছেঁড়া করে সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট সংবিধানে পরিণত করেছে। তার থেকে মুক্ত হতে আজও আমরা পারিনি।

রাষ্ট্র ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বা আত্মপরিচয় কোনোটাই ছিল না, যেন পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে যায় আত্মবিস্মৃত দিকভ্রান্ত। সংস্কৃতি চর্চা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেই আত্মপরিচয় বিস্মৃত, পথ হারানো দিকভ্রান্ত জাতিকে আবার নিজ পরিচয়ে ফিরিয়ে আনলেন জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাতির যাত্রাপথকে মোড় ঘুরিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাস্তায়। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস জোগালেন। আজ তাই ফিরে দেখি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয়, খাদ্য রপ্তানি করেছে বিভিন্ন দেশে।

সকল মানবিক সূচকে পাকিস্তানকে তো ছাড়িয়ে গেছেই, বন্ধু রাষ্ট্র ভারতকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। ঋণ দিচ্ছে অন্যদেশকে। কোনো যুদ্ধ বিগ্রহ না করেও বাড়িয়েছে নিজের ভূমি, ভারতের সাথে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে।

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে রুচিশীল, সহনশীল, মানবিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা চিরস্থায়ী উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারব।

সমুদ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজের আধিপত্য। মহাকাশে পাঠিয়েছে স্যাটেলাইট। একটা পদ্মাসেতু নিজে করার সাহসী সিদ্ধান্ত এই দেশের আপামর জনতার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল এক পলকে। তিনি ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যান দিয়ে শতবর্ষের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। উন্নয়নের বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত লয়ে।

দেশ আজ উন্নয়নশীল, ২০৪১-এ উন্নত দেশের প্রত্যয়ে দৃপ্ত। আজ তাই বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছরপূর্তির ক্ষণে, এক শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে সকল অপ্রাপ্তি, দুঃখবোধ ছাপিয়ে আমি আশাবাদী। দেশ যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে আছে, এগিয়ে যাবেই। যদিও জানি এই যাত্রা মসৃণ হবে না।

অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, সহনশীল এক সমাজ বিনির্মাণের পথে অনেক বাধা, অনেক ষড়যন্ত্র চলছেই। দুর্নীতি দমন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে বাংলার মাটিকে মুক্ত করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা—কত কাজ বাকি! কত পথ যেতে হবে হেঁটে তবেই না পৌঁছাতে পারব সোনার বাংলায়। 

মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের মানবতাবোধ নষ্ট করে সমাজকে অসহনশীল, স্বার্থপর করে তুলছে। মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। প্রয়োজন উন্নয়নের মেগা প্রজেক্টের মতো এবার ‘মানুষ গড়ার মেগা প্রজেক্ট’। যদি সোনার মানুষ গড়তে পারি, তারাই আমাদের সোনার বাংলা গড়ে দেবে।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা করা প্রয়োজন এখন। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে রুচিশীল, সহনশীল, মানবিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মানুষ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা চিরস্থায়ী উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারব।

একমাত্র সোনার মানুষের হাতেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন সত্য হতে পারে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যার পক্ষেই তেমন সোনার মানুষ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তব করা সম্ভব। তাই আজ বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমি মানুষ গড়ার মেগা প্রজেক্ট চাই, চাই সোনার বাংলার সোনার মানুষ—যাদের হাতে দিয়ে যাব আমাদের সকল শোক, শক্তি আর স্বপ্ন। 

অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী ।। শহীদ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর সন্তান