ছবি : সংগৃহীত

আজকের রাজনীতি নিয়ে অনেকেই বীতশ্রদ্ধ। শুধুই ব্যক্তিসর্বস্ব রাজনীতি। আদর্শের বালাই নেই। সর্বত্র একই অবস্থা। বিভিন্ন দলে কোন্দল, আদর্শ বিচ্যুতি। কে আসলে কী রাজনীতি করছেন, তাও বোঝা মুশকিল। ঠিক এমন দিনে স্মরণ করছি সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। আজ তার প্রয়াণ দিবস।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিণী। কিন্তু এটুকুই তার পরিচয় নয়। তিনি নিজেও রাজনীতিক ছিলেন এবং ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমদ এক লেখায় লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন এক অনন্য জুটি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে রুখে দেশমুক্তির জন্য একজন ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের হাল, অন্যজন বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ধরেছিলেন আওয়ামী লীগ দলের হাল।

দেশ ও দলের চরম সংকটকালে তাদের ওপর যখন নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়, তারা সেই সময় দেশ, জাতি ও দলকে উজ্জীবিত করেছিলেন আশার আলো ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে।

রাজনীতিতে সবাই জ্বলে উঠতে পারেন না। কিন্তু সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আজীবন আলো ছড়িয়েছেন এই ভুবনে। স্বামী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি কারাগারে নির্মম হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারিয়েছেন। সেই শোক সঙ্গে করে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে এক বৈরী, অনিশ্চিত সময়ে আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মী থেকে নিজের মেধা, যোগ্যতায় কাণ্ডারি হয়ে দুঃসময়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এক কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। ভয় ছিল, শঙ্কা ছিল এবং তাই অনেক বড় বড় নেতা যখন ঘরের দুয়ার খুলে পথে নামেননি, তখন দলের ঐক্য আর সংহতি ধরে রাখতে এগিয়ে আসেন জোহরা তাজউদ্দীন। নিভৃতচারী মানুষটি এক গভীর দায়িত্ববোধে তাড়িত হয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন এক অনন্য জুটি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে রুখে দেশমুক্তির জন্য একজন ধরেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের হাল, অন্যজন বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ধরেছিলেন আওয়ামী লীগ দলের হাল।  

বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ নেতৃত্বের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে যে শূন্যতা নেমে এসেছিল সেই সময় ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে, এক ঘরোয়া বৈঠকে, সর্বসম্মতিক্রমে জোহরা তাজউদ্দীনের ওপর অর্পিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব।

একজন সচেতন সমাজকর্মী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোহরা আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা হিসেবে, বাকশাল-উত্তর এই দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। দলের ভেতর সংহতির অভাব ছিল নানা কারণে এবং দলে ঐক্য ফেরানোর জন্য বিদেশ থেকে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ফিরে আসাটা অনিবার্য ছিল।

অনেকের সাথে জোহরা তাজউদ্দীনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় স্বজনের রক্তে ভেজা দেশে ফিরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। বয়সকে উপেক্ষা করে মাঠে থেকেছেন, আন্দোলনে লড়াই করেছেন এবং সবসময় গভীর মমতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে থেকেছেন।

সেই সময়টির দিকে আরেকবার যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখি, সে সময় ছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকাল। তিনি একে একে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন একাত্তরের গণহত্যাকারী পরাজিত দলগুলোকে। এবং এদের টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা।

সব ধরনের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ। সামরিক বাহিনী, পুলিশের দৃষ্টি আওয়ামী লীগের দিকে। দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই জেলে অথবা পলাতক। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ। দলের এই চরম দুর্দিনে, সামরিক শাসক আরোপিত প্রবল বাধা নিষেধ ও হুমকির মধ্যেও জোহরা তাজউদ্দীন দৃঢ়তার সাথে পথ চলেছেন।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আমরা এমন এক সময়ে স্মরণ করছি, যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নমানের, যখন লাগামহীন দুর্নীতির দাপটে রাজনীতি, যখন জীবনের সর্ব-অসম্মানে পীড়িত সৎ মানুষেরা, যখন শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগসঞ্চিত মূল্যবোধগুলোর উপরে ঘনিয়ে তুলেছে সর্বনাশের ছায়া।

দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটেছেন দলের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে, দলের ভেতর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। মনে রাখা দরকার, সময়টি কিন্তু এখনকার মতো ছিল না। রাস্তাঘাট এখনকার মতো নয়, বিদ্যুৎবিহীন দুর্গম এলাকাগুলো সফর করা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু একজন নারী, যিনি তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে তখনো ট্রমার ভেতর ছিলেন, সেই জোহরা তাজউদ্দীন নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে দলের মাঝে নব-উদ্যম ফিরিয়ে আনেন।

জোহরা নিজের জন্য ভাবেননি, ভেবেছেন দলের জন্য, দেশের জন্য। খুঁজে দেখতে চেয়েছেন কোন পথে দলকে এগিয়ে নিবেন, আবার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের আদর্শের কথা বলবেন এবং এভাবেই তিনি অগ্রবর্তী হয়েছেন। চিন্তার সবলতায় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, নিজ দলে শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখতে ত্যাগ স্বীকারের যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন তা আমাদের রাজনীতিতে বিরল।

জোহরা তাজউদ্দীন জানতেন ১৯৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে হারানো জমি ফিরে পেতে গেলে আওয়ামী লীগকে দুটো কাজ করতে হবে। একটি হলো দল ও দলের কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনা এবং আরেকটি হলো বেশি বেশি করে মানুষকে দলের দিকে টানা। এ কাজটা তিনি করেছিলেন দক্ষতার সাথে। প্রতিক্রিয়াশীল সময়ে জোহরা ছিলেন মানুষের স্বার্থরক্ষায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রহরী, এক নির্ভরযোগ্য সেনানী।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আমরা এমন এক সময়ে স্মরণ করছি, যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিম্নমানের, যখন লাগামহীন দুর্নীতির দাপটে রাজনীতি, যখন জীবনের সর্ব-অসম্মানে পীড়িত সৎ মানুষেরা, যখন শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগসঞ্চিত মূল্যবোধগুলোর উপরে ঘনিয়ে তুলেছে সর্বনাশের ছায়া।

একজন জোহরা তাজউদ্দীন তার স্বামীর মতোই বৈরী স্রোতেও ছিলেন সততা, ত্যাগ ও নীতি-আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার সততা, প্রজ্ঞা, নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নিরহংকার জীবনযাপন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আজীবন তিনি একটি উদার গণতান্ত্রিক, ন্যায়পরায়ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করে গেছেন। তার সেই স্বপ্নের লড়াইটা ফিরে আসুক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি