ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই উপমহাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আগের ইতিহাস বাদ দিলেও কেবল বাংলাদেশের জন্ম ও তার পরবর্তী ইতিহাস মানেই আমাদের প্রাণের এই বিদ্যাপীঠের ইতিহাস। এইতো এখন চলছে শতবর্ষের আলোকসজ্জা। নানা উৎসবে পালিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবর্ষ। এই একশো বছরের আলোচনায় আমাদের উদ্বেলিত হওয়ার কথা ছিল কতটা সামনে গেলাম সেই গল্প নিয়ে। কতজন নারী গ্র্যাজুয়েট বের হলো সেই গর্ব করে। অথচ কী পরিতাপের বিষয়, এই মুখ্য সময়ে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীনতম আইন নিয়ে।

আমরা জানি আমাদের দেশ এগোচ্ছে, আধুনিক হচ্ছি আমরা সবাই কিন্তু আধুনিকায়ন নেই আমাদের আইনগুলোর। তাইতো বারেবারে ধাক্কা খাচ্ছি আমরা। ঠিক একইভাবে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোরও নেই কোনো পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংস্কার।

মূল আলোচনায় আসা যাক। কিছুদিন আগে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূল ধারার মিডিয়ায় আলোচনায় আসল একটি সংবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে বিবাহিত বা অন্তঃসত্ত্বা কোনো শিক্ষার্থী সিট পাবে না বা থাকতে পারবে না।

আমার পাশের রুমেই একজন দিদি থাকতেন। হঠাৎ একদিন আমরা জানতে পারলাম তিনি মা হতে চলেছেন। কিন্তু তার মনে ভয়, যদি হল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় তিনি কোথায় যাবেন? ঢাকায় তার এমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যেখানে গিয়ে তিনি এই সময়টা থাকতে পারেন।

আমি যেহেতু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং হলেও ছিলাম। ভাবতে বসলাম আমাদের সময়ে কী ছিল? ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি আদিম ও বর্বর আইন এখনো চালু থাকতে পারে।

ঘটনা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল, আমার পাশের রুমেই একজন দিদি থাকতেন। হঠাৎ একদিন আমরা জানতে পারলাম তিনি মা হতে চলেছেন। কিন্তু তার মনে ভয়, যদি হল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় তিনি কোথায় যাবেন? ঢাকায় তার এমন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যেখানে গিয়ে তিনি এই সময়টা থাকতে পারেন।

পরীক্ষা চলছিল সেই সময়টাতে। সেই দিদিকে দেখতাম কত কষ্ট করে তিনি রান্নাবান্না করে নিজেকে সামলে ক্লাসেও যেতেন। যেহেতু আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম এবং আমাদের সময়ে হলের সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে দারুণ ঐক্য ছিল। আমরা সবাই মিলে তাকে সাহস দিয়েছিলাম যে, কিছু হলে আমরা দেখব। তবে শেষ পর্যন্ত হলের আপারাও সহযোগিতা করেছিল বলে তাকে হল ছেড়ে যেতে হয়নি।

একদিন ঘুম থেকে উঠে আমরা সংবাদ পেয়েছিলাম দিদির একটি ফুটফুটে সন্তান হয়েছে এবং তিনি সুস্থ আছেন। এতকাল পরে এসেও একই ধরনের সংবাদ আমাদেরকে বিমর্ষ করে দেয়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আছে নারীর ক্ষমতায়নের অর্জনও। আন্তর্জাতিকভাবে নারীর অগ্রগতির ইস্যুতে আমাদের অনেক স্বীকৃতি আছে। তাহলে এই একবিংশ যুগেও কেন একজন বাংলাদেশি নারী শিক্ষার্থীকে বিবাহিত বা মাতৃত্বকালীন সময়কে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে? তার মানে কি বিবাহিত হলে উচ্চশিক্ষার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে?

এমনিতেই আমরা জানি করোনাকালে আমাদের সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যার একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে গেছে।

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা একদিকে বলছেন, নারীদেরকে আবার বিদ্যালয়মুখী করতে হবে। আমাদের এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নারী শিক্ষা একটি অন্যতম সূচক।

এমন এক সময়ে যখন বের হয়ে আসে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শত বছরের পুরনো একটি প্রতিষ্ঠান এখনো আদিম যুগের আইন দিয়ে নারী শিক্ষাকে আটকাতে চাইছে তাহলে আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনার ঘাটতিই সামনে চলে আসে।

যদি বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকার যোগ্যতা হারায় তবে বিবাহিত ছাত্ররা কেন থাকার সুযোগ পাবে? কেন বিবাহিত বা সন্তানের পিতা হওয়ার পরেও কোনো ছাত্রকে হলে ওঠার ফর্মে সেসব তথ্য দিতে হয় না?

বহুবার আমরা বলার চেষ্টা করেছি যে, যেকোনো উন্নয়ন হতে হয় সামগ্রিক বিবেচনায়। অর্থাৎ, এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে একত্রিত করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের কাজটি শুরু করতে হয়। এই জায়গাটি হচ্ছে না কোথাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম একটি ভাগীদার।

আমরা দেখলাম, ছাত্রীদের চার দফা দাবির প্রতিটা ইস্যুই প্রাচীনকালের বানানো আইন সংশ্লিষ্ট। এটাই আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, আধুনিকায়নের দিকটি উপেক্ষিত।

আমাদের উপাচার্য বলেছেন, পূর্বসূরিরা আমাদের ভালোর জন্যই আইনগুলো করে দিয়ে গেছেন। আমি বিনয়ের সাথে স্যারকে প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে তিনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো ১০০ বছর আগের মাপকাঠিতে দেখতে চান?

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, তিনি একবিংশ শতকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ হওয়ার পথে তিনিও একজন সারথি। তার মাথায় যদি এমন পুরনো চিন্তা থাকে তাহলে আমাদের আগানোর রাস্তায় আলো ফেলবে কে?

প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে, যদি বিবাহিত ছাত্রীরা হলে থাকার যোগ্যতা হারায় তবে বিবাহিত ছাত্ররা কেন থাকার সুযোগ পাবে? কেন বিবাহিত বা সন্তানের পিতা হওয়ার পরেও কোনো ছাত্রকে হলে ওঠার ফর্মে সেসব তথ্য দিতে হয় না?

আমরা কে না জানি, ছাত্র হলগুলোতে প্রচুর অছাত্রের বসবাস চলে মাসের পর মাস। অছাত্রদের ভিড়ে প্রকৃত ছাত্ররা সিট পায় না সময়মতো। অথচ যত নিয়ম কেবল ছাত্রীদের জন্য। কেন? নারী বলে? তারা সহজে প্রতিবাদ, মারামারি করতে পারে না বলে? নারীরা কি অপাঙক্তেয়? কেন তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে কেবল একটি সামাজিক প্রক্রিয়ায় সে আছে বলে? বিয়ে করা বা মা হওয়া কোনো নারীর জন্য অপরাধ নয়।

তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়মের। অবিলম্বে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে যে নিয়মে নারী বিদ্বেষী বা নারীর অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ করে এমন নিয়ম বা বিধি আছে সেগুলোকে পরিবর্তন বা বাতিল করা হোক।

আধুনিক বাংলাদেশে সবাই যার যার যোগ্যতার মাপকাঠিতে এগিয়ে যাবে। সেখানে কে পুরুষ, কে নারী সেই বিবেচনা বাদ দিতে হবে। মনের আধুনিকায়ন ব্যতীত লক্ষ পাওয়ারের আলোকসজ্জা করেও অন্ধকারকে আটকানো যাবে না।

লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট