বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধ শতবর্ষ পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আশা-নিরাশার দোলাচলে রয়েছি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি বিস্ময়কর। বিজয়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। দেশ ছিল আমদানি-নির্ভর, এক তৃতীয়াংশ খাদ্য আমদানি করতে হতো, দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায়। জনসংখ্যা ১৯৭২ এর সাড়ে সাত কোটি থেকে বর্তমানে প্রায় সতেরো কোটিতে পরিণত হয়েছে। অথচ, বর্তমান অর্থবছরে বাজেট ছয় লাখ কেটি টাকা, খাদ্য উৎপাদনে আমরা কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া স্বনির্ভর।

করোনা পূর্বকালে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে বিশ শতাংশ, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। প্রধানত, প্রবাসী আয়ে স্ফীত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটায় উন্নত হয়েছে যে, আমরা শ্রীলঙ্কাকে বৈদেশিক মুদ্রার সক্ষমতায় সহায়তা করেছি।

স্বাধীনতার পর তাচ্ছিল্য করে অনেকে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট বলে অভিহিত করেছিল। আজ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা অর্জিত হয়নি, ঋণখেলাপিদের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়েছে, বারবার দাবি করা সত্ত্বেও ব্যাংকিং কমিশন গড়ে উঠেনি।

গত দুই দশকে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে সাত শতাংশ এবং করোনাকালে পাশ্চাত্যের বহুদেশে যখন ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশে জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা পাঁচভাগ অতিক্রম করেছে।

অধিকাংশ দেশে জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধি ঘটলেও সামাজিক সূচকে তার প্রতিফলন ঘটে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক সূচক সমূহে ইতিবাচক অগ্রগতি দৃশ্যমান। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হারের বিশাল উন্নতি হয়েছে, ছয় কোটি ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা লাভ করছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি।

তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা অর্জিত হয়নি, ঋণখেলাপিদের সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়েছে, বারবার দাবি করা সত্ত্বেও ব্যাংকিং কমিশন গড়ে উঠেনি।

বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যথাযথ তালিকার বিষয়ে বিচারালয়ের তাগাদা সত্ত্বেও গড়িমসি চলছে। দেশের সর্বত্র ক্ষমতাবানদের লোভের সংক্রমণ সমাজে অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সামাজিক অবক্ষয়। বহুক্ষেত্রে দুর্নীতি ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই দৃশ্যমান। এই প্রতিকারহীন দুর্বৃত্তায়ন সরকারের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ম্লান করতে উদ্যত হয়েছে।

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যায় বহুজন আচ্ছন্ন হয়েছে, আমরা কতটা মুসলমান আর কতটা বাঙালি এ দ্বিধা আজও গেল না।

সর্বোপরি, ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে ধারার রাষ্ট্র গঠনের জন্য আত্মদান করেছে, যার ভিত্তিতে বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চারনীতি প্রণীত হয়েছিল, সেটি আক্রান্ত হয়েছে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর এই নীতিসমূহ সংশোধিত হয়েছিল, দেশকে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় পরিচালনার পরিকল্পিত প্রয়াস চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানে এই নীতিসমূহ প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যায় বহুজন আচ্ছন্ন হয়েছে, আমরা কতটা মুসলমান আর কতটা বাঙালি এ দ্বিধা আজও গেল না। বস্তুতপক্ষে সমাজে এই নীতিসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার ফলে সরকার প্রায়শ সমঝোতার পথ গ্রহণ করে, আর তার বিস্তার লক্ষ্য করা যায় তৃণমূল পর্যায়ে।

সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এ দায় কেবল সরকারের নয়, সমাজের সর্বজনকে এ দায়িত্ব পালনে সজাগ হতে হবে। এ প্রত্যাশা পূরণে সকলে অগ্রসর হবেন, এটিই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আকাঙ্ক্ষা।

ডা. সারওয়ার আলী ।। ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; নির্বাহী সম্পাদক, ছায়ানট