কৈশোরে শুনতাম এক মৃত্যু ফাঁদের কথা, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। এই সড়কের কিছু সেতু ছিল, যার কাছাকাছি আসলেই হয়তো বাস, ট্রাক বা ব্যক্তিগত বাহনের নার্ভাস ব্রেকডাউন হতো। রেলিং ভেঙে খালে-নদীতে পড়ে যাওয়ার কাহিনি ফুরায়নি এখনো। ঐ সময়ের সড়কের ঘাতক হিসেবে শুনেছি ট্রাকের নাম।

ট্রাকের ওজন তখন ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’। সেই ওজন নিয়ে গতি ও চলাচল কখনোই স্বাভাবিক রাখতে পারেনি ট্রাক। প্রায়ই সড়কের বাইরে চলে আসত। পাশের খাদে পড়ে যাওয়া কিংবা সরাসরি কারো সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার অভ্যাস এখনো যায়নি ট্রাকের। যদিও এখন তাকে বহু রূপে দেখা যায়। বহনের সক্ষমতাও বেড়েছে।

দশকের পর দশক পেরিয়ে আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। প্রশস্ত হয়েছে সড়ক। নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে। বাহনের চাপ বেড়েছে সড়কে। একই সঙ্গে বিচিত্র ধরনের বাহনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। বিচিত্র বাহন, বিচিত্র গতি, মহাসড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার জন্য মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। সেই বিশৃঙ্খলা মহাসড়ক থেকে গ্রামগঞ্জ হয়ে রাজধানীতে এসে পৌঁছেছে।

রাজধানীতে উড়ালপথ, মেট্রোরেল, আন্ডারপাস-রকমারি সড়ক অবকাঠামো তৈরি হলেও, মেরামত করা যায়নি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে। বরং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে বারবার। রাজধানীতে গণপরিবহন রুটকে এক বা একাধিক কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসার প্রকল্প নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা হিমঘরেই রয়ে গেছে।

রাজধানীতে উড়ালপথ, মেট্রোরেল, আন্ডারপাস-রকমারি সড়ক অবকাঠামো তৈরি হলেও, মেরামত করা যায়নি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে। বরং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে বারবার।

ঢাকার রাস্তায় বাসের এলোমেলো বেপরোয়া চলাচলে প্রাণ ঝরছে নিয়মিত। ২০১৮ সালে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর বাস চাপায় মৃত্যুর পর সারাদেশে শিক্ষার্থীরা পথে নেমে এসেছিল নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সেই আন্দোলনের সঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আন্দোলন সড়ককে নিরাপদ করতে পারেনি।

নিয়মিতই সারাদেশে গণপরিবহনের চাকার নিচে শিক্ষার্থীসহ নানা বয়স ও পেশার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। এই প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলা যাবে না। হত্যা বলতে হবে। কারণ দেখা গেছে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি, হাফ ভাড়া নিয়ে তর্ক, কিংবা কোথাও নামতে চাইলে হেলপার বাস থেকে যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। রামপুরা সড়কে নভেম্বর মাসেও এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হলো বাসের ধাক্কায়।

বাস ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সড়কে মোটর সাইকেল এখন দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে উঠেছে। সড়কে-মহাসড়কে তাদের গতি বেপরোয়া। এমন দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো, যেদিন সড়ক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা মুক্ত ছিল। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে প্রতিযোগিতা।

সমাজের উঁচুতলার সন্তানেরা মাদক সেবন করে, অপরিণত বয়সে গাড়ি নিয়ে পথে নামছে। এক-দুই মাসের মধ্যে রাজধানীতে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে উঠতি তরুণদের দ্বারা। তরুণদের গুটিকয়েক যখন পুঁজির তাপে সড়কে বেপরোয়া, তখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কিশোর—তরুণ নিরাপদ সড়কের দাবিতে এখনো সোচ্চার।

প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলা যাবে না। হত্যা বলতে হবে। কারণ দেখা গেছে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি, হাফ ভাড়া নিয়ে তর্ক, কিংবা কোথাও নামতে চাইলে হেলপার বাস থেকে যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে।

আমরা ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দিনে যদি ফিরে যাই, দেখব তখন ওদের মূল স্লোগান ছিল-‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং ‘রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে’। সঠিক বিচার চাওয়ার অধিকার ওদের আছে। আমরা যে বিচার চাইতে পারিনি বা চেয়ে চেয়ে এখনো আদায় করতে পারছি না, সেই বিচার ওরা আদায় করবে এই বিশ্বাস রাখতে চাই।

একই সঙ্গে ওরা যে রাষ্ট্রের মেরামতের কথা বলছিল, দাবি তুলেছিল সেটাও যৌক্তিক। কারণ গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রের কোনো কোনো দপ্তরে অলসতা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো দপ্তর দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যার সঠিক চিকিৎসা হয়নি। তাই সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা যায়নি।

মেয়াদোত্তীর্ণ বাহন পথে চলছে। লাইসেন্স ছাড়া চালক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক গাড়ি চালাচ্ছে। আমাদের দেখতে হলো, পরিচ্ছন্নতা কর্মীও বসছে গাড়ির চালকের আসনে। এত অসুখ ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে সড়ক নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়। তাই দুই বছর পর আবার শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে দাবি উঠেছে-নিরাপদ সড়কের।
আমরা চাই না, এই দাবিতে ওরা সড়কে থাকুক। কারণ করোনা মহামারি শিক্ষা জীবনের অনেকটা ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। এখন ওদের পাঠের সঙ্গেই থাকা জরুরি।

রাষ্ট্রের যারা অভিভাবক, বিভিন্ন দপ্তরের যারা তত্ত্বাবধায়ক তাদের উচিত নিজ নিজ ত্রুটি মেরামত করে, সন্তানদের নিরাপদ সড়ক উপহার দেওয়া। জানি না—এই উপহার দেওয়ার সক্ষমতা আমরা কবে অর্জন করব।

তুষার আবদুল্লাহ।। গণমাধ্যমকর্মী