ছবি : সংগৃহীত

স্মৃতির দিকে তাকিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একটি সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। মধ্যবিত্তের ভাষার মর্মে সজোরে আঘাত করেছিলেন তিনি। মনে পড়ে, পরিশীলিত চিন্তায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ ইলিয়াসের স্ল্যাং পড়ে লজ্জিত হয়েছেন; ভেবেছেন, গল্প উপন্যাস নয়, ‘গালাগালে ভরা সাহিত্য’; অন্য পক্ষে শুদ্ধ নন্দনতত্ত্ববাদীরা ভেবেছেন, ইলিয়াস বুঝি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির কচকচি নিয়ে হাজির হয়েছেন।

হুমায়ুন আজাদের মতো প্রবল পণ্ডিত ইলিয়াসের উপন্যাসের প্রথম পঞ্চাশ পৃষ্ঠা পড়ার আগেই স্থগিত রেখেছিলেন। কেবল যেন খুশি হয়েছিলেন মার্কসবাদীদের একাংশ; তাদের ভাষ্যে চলমান জীবন ও ইতিহাসের বৃহৎ একটি প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে ইলিয়াসের লেখায়; শ্রেণি সংগ্রাম বোঝার ক্ষেত্রে যা অগ্রগণ্য। কিন্তু তাদেরও অন্য এক অংশ ইলিয়াসের ভাষা ও সংলাপের শ্রেণি চ্যুতিকে সহজভাবে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না; তারা পেয়েছিলেন রুচির বিকার, প্রগতির ব্যত্যয়। তাহলে ইলিয়াসকে কোন নিরিখে বিচার করব? শিল্পসাহিত্যের কোন মানদণ্ডে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাব? 

বাংলাদেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন ভাষ্য পড়ে ও শুনে কখনো কখনো মনে হয়েছে ইলিয়াসের কথকতা নয়, প্রধান আলোচ্য তার মধ্যবিত্তের রাজনীতি, যৌনতা কিংবা গণসংস্কৃতি ও রাজনীতির সেতু জোড়া দানের চেষ্টা কিংবা ব্যর্থতা।

ইলিয়াসের গল্প-উপন্যাসের চেয়ে ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ বইয়ের কিছু প্রবন্ধকে আলোচনায় এনে এই তর্ক জারি রাখা হয়েছে এক কাঠি ওপরে। কিন্তু সবকিছুর আগে মনে রাখার বিষয় এই যে, ইলিয়াস একজন গল্প-উপন্যাস রচয়িতা। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ লিখতে বসেননি তিনি। প্রথম বিবেচ্য এই হওয়ার কথা যে, গল্প বলার কাজ তিনি ঠিকভাবে করতে পেরেছেন কি না। শিল্পের বিচিত্র পৃথিবীতে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার কাজ কী? কোন ধরনের কাজ তিনি করেছেন?

বাংলাদেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন ভাষ্য পড়ে ও শুনে কখনো কখনো মনে হয়েছে ইলিয়াসের কথকতা নয়, প্রধান আলোচ্য তার মধ্যবিত্তের রাজনীতি, যৌনতা কিংবা গণসংস্কৃতি ও রাজনীতির সেতু জোড়া দানের চেষ্টা কিংবা ব্যর্থতা।

একজন কথাকার মূলত গল্পের কারবারি। লিখতে গিয়ে তিনি প্রধানত একটি গল্প বলেন; উপন্যাসেও একটি প্রধান গল্প থাকে। সে গল্পের একটি শুরু থাকে, মধ্যবর্তী পর্যায় থাকে, আর থাকে সমাপ্তি। প্রাচীন গল্পকাঠামো অবলম্বনে এই হলো মান্য কৌশল।

একজন কথক বেছে নেন দরকারি শৈলী; কতখানি তিনি বলবেন অথবা বলবেন না, কিংবা কখন, কোন কথাটি বলবেন তার একটি হিসেব মনে মনে কষে নেন তিনি। শৈলী ও কলাকৌশলের এই সচেতনতা লেখক ও লেখার স্বতন্ত্র একটি অবস্থান তৈরি করে দেয়।

বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভূমিকা বুঝতে গেলে প্রথমেই নজরে পড়ে তার শৈলী ও কৌশল। অনেকের মধ্যে বিশেষভাবে চেনা যায়, এই গদ্যরীতি আর কারও নয়, কেবলই ইলিয়াসের।

গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে নিজস্ব শৈলী সম্পন্ন গদ্যকারের ইতিহাস খুঁজতে গেলে অনিবার্যভাবে সে তালিকায় স্থান পাবেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বিভিন্ন শ্রেণি পরিচয়ে আবদ্ধ বাঙালির বাচন ভঙ্গি, স্ল্যাং জোড়া দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন দীর্ঘ বাক্যের স্রোত। কোনো একটি ছোট প্রসঙ্গকে তিনি চাইলেই দিতে পারতেন দীর্ঘ অবয়ব। চরিত্রের শরীর, পোশাক, চাহনি, ভাষার সমুদয় বিবরণ উঠে এসেছে। কোনো স্থানের জল-মাটি-আবহাওয়া, বস্তুগত সংস্কৃতির বর্ণনা তুলে দিতেন ইলিয়াস। কেন দিতেন আগাপাছতলা বয়ান?

বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভূমিকা বুঝতে গেলে প্রথমেই নজরে পড়ে তার শৈলী ও কৌশল। অনেকের মধ্যে বিশেষভাবে চেনা যায়, এই গদ্যরীতি আর কারও নয়, কেবলই ইলিয়াসের।

এ প্রশ্নের জবাব আছে তার ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ নামের প্রবন্ধে। তিনি ভেবেছেন, প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের সংস্কৃতির ভেতর একজন কৃষক কিংবা শ্রমিকের বেদনাগুলো ছোট প্রাণ ছোট কথার আদর্শে আটকানো সম্ভব নয়। কোনো দুঃখকে ছোট বলা যাচ্ছে না। নিজের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘সমাজের প্রবল ভাঙচুর, সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতির ফলে মানুষের গভীর ভেতরের রদবদলের পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছোটগল্পের শরীরেরও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য।’ অর্থাৎ মানুষের বেদনার প্রেক্ষাপট এত বৃহৎ হয়ে পড়েছে যে, ছোটগল্পের অবয়ব আর ছোট থাকছে না; গল্পের যে রাবীন্দ্রিক আদর্শ বহুকাল ধরে অনুসৃত সেটিও সচল থাকছে না। অনেকটা তার ফর্মের কারণেই ঔপন্যাসিক আয়তন বাড়িয়ে দেন। 

কথাসাহিত্য সম্পর্কে ইলিয়াসের এই উপলব্ধি ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, তার গল্প-উপন্যাসে ঘটেছে অবয়ব বদলের আয়োজন। তিনি ঢুকে গিয়েছেন বিবরণের ভেতর; স্থান, কাল, চরিত্র অনেক ‘ডিটেল’ নিয়ে হাজির হয়েছে। অনুপুঙ্খভাবে তিনি চলমান ঘটনাকে দেখেছেন। হয়তো বাস্তবতা ও অনুপুঙ্খতার প্রয়োজনে তিনি ডায়েরিতে টুকে রাখতেন সামাজিক রাজনৈতিক টুকিটাকি তথ্য। দেশ, কাল রাজনীতির সামান্য একটু উল্লেখ পুরো গল্পের জন্য কিংবা ভাববস্তুর জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এ ধরনের উল্লেখ পড়ে পাঠক হয়তো ভাবে না, এর কী দরকার! যেমন ‘উৎসব’ গল্পের আনোয়ারের প্রসঙ্গে ইলিয়াস লিখেছেন, ‘একটি কোণে আলোকিত কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র চর্চায় কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ লোক ও মেয়ে সুন্দর একটি কর্নার তৈরি করে নিয়েছে। আনোয়ার আলির কাঙাল সাধ হয় সেও ঐখানে ওদের সঙ্গে ভিড়ে যায়।’ কিংবা আনোয়ারের বন্ধু হাফিজের গলায় ইলিয়াস প্রচুর ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে সংলাপ বসিয়ে দিয়েছেন; কারণে অকারণে চরিত্রটি তার লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফর্দ তুলে ধরে।

‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে এ ধরনের ডিটেলিং আরও বেশি। প্রশ্ন জাগে, কোন অনিবার্যতায় এসব ডিটেল জরুরি হয়ে উঠল? 

ইলিয়াসের সাহিত্য কখনোই গণমানুষের ভাষায় রচিত গণসাহিত্য নয়। আদতে আধুনিক ইতিহাসের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া আঙ্গিক হিসেবে গল্প-উপন্যাসের সেই সামর্থ্যই নেই।

নিশ্চিতভাবে উপন্যাসের আকার আয়তন একে সমর্থন জুগিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক কার্যকারণকে বলা যায়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। সামাজিক শ্রেণিগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বোঝা যায় না আনোয়ারের ‘কাঙাল সাধ’ বিষয়ক আলাপ না তুললে। বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র চর্চাকে নিবেদিতপ্রাণ মানুষের ‘কর্নার’ না বললে ঠিকঠাক বোঝা যায় না যে, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি ও রাজনীতি আদতে খণ্ডিত।

ইলিয়াস তার সমগ্র সাহিত্যে এরই সমালোচনা করে গেছেন। শ্রেণি রাজনীতির বাহাসকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নির্মাণ করে গেছেন কথাসাহিত্যের পাটাতনে। সামাজিক শ্রেণি, বর্গ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের উপস্থাপনা কখনোই প্রামাণিক হয়ে ওঠে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রচয়িতার ভাষা, শ্রেণি, বর্গ, গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে ধরতে পারে। হাফিজ কিংবা আনোয়ারের শ্রেণিকে বুঝতে চাইলে বোঝা দরকার ওই শ্রেণির ভাষা।

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কারণেই ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে ইলিয়াস কাৎলাহার বিলের গপ্পো ফাঁদেন; প্রথম অনুচ্ছেদে উঠে আসে তমিজের বাপ, তমিজের বাপের বাপ বাঘাড় মাঝি, মজনু শাহ, গোরা সেপাই, ব্রিটিশ সেনাপতি টেলরের প্রসঙ্গ।

একটি দীর্ঘ কালের গল্প বলবেন বলে ইলিয়াস পাঠককে নিতে চান সময়ের বিশাল পরিসরে। উত্তরবঙ্গের গণ ইতিহাসের উপাদানকে ভিত্তি বানিয়ে ইলিয়াস বিনির্মাণ করলেন সমাজ ও ইতিহাসের-প্রবল ক্ষমতাকাঠামো যেটি দমিয়ে রাখে। আর তাই ‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ের হাড্ডি খিজির, ‘খোয়াবনামা’র তমিজের মতো মানুষেরা ইতিহাসের কর্তাসত্তার সামনে সক্রিয়তার বয়ান নিয়ে হাজির হয়েছে। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সমান্তরালে টিকে থাকা শ্রেণিসংগ্রাম এবং নিম্নবর্গের প্রসঙ্গকে দারুণভাবে জানান দিয়েছেন ইলিয়াস। কিন্তু এতে করে ইলিয়াসের গল্প উপন্যাস কি হয়ে উঠেছে প্রচারধর্মী সাহিত্য?

নাহ, ইলিয়াস মূলত গল্পই শোনালেন; রাজনীতির অলিগলি চোরাগলিকেও চিহ্নিত করলেন। কিন্তু পাঠক মথিত হলো সাংস্কৃতিক অতীতে। সেই অতীতকে ইলিয়াস কখনোই বলছেন না সোনালি অতীত—যেরকম করে থাকে জাতীয়তাবাদ। গল্পের মীমাংসায় দিচ্ছেন না কোনো রাজনৈতিক ফয়সালা।

ঘটনার নিয়মে চরিত্র এগোচ্ছে, চরিত্রের প্রতিক্রিয়ায় ঘটনা এগোচ্ছে। কথাকার কথা বলছেন আগাগোড়া; তবে পার্টি রাজনীতির মতাদর্শ লেখকের দৃষ্টির ওপর বিশেষ চশমা পরিয়ে দিচ্ছে না, সেই চশমা দিয়ে লেখক ঘটনা, চরিত্রের জীবনের সবটা দেখছেন না। তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিক বাহাসের পরিভাষাগুলো কোনো কোনো গল্পের ভেতর থেকেও যাচ্ছে, কিন্তু গল্পের কাঠামোর উপর সওয়ারি হয়ে চেপে বসছে না রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের গল্প। 

গল্প উপন্যাস লিখতে গিয়ে বাংলা ভাষার অনেক লেখকই ভাবাদর্শিক খোপে বন্দি হয়ে পড়েছেন, ইলিয়াস সেই বন্দিত্ব মেনে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। অবশ্য এ কথা মানতে হবে যে, সমাজ কাঠামোর তলায় থাকা বাসিন্দাদের প্রতি তার প্রবল অনুরাগ ছিল, গণসংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রতি তার পক্ষপাত ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু ইলিয়াসের সাহিত্য কখনোই গণমানুষের ভাষায় রচিত গণসাহিত্য নয়। আদতে আধুনিক ইতিহাসের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া আঙ্গিক হিসেবে গল্প-উপন্যাসের সেই সামর্থ্যই নেই। শ্রেণি ও আঙ্গিকের সীমানা উজিয়ে লেখক পারেন শুধু উঁকি দিয়ে দিগন্ত দেখার সুযোগ; ইলিয়াস সম্ভবত অচেনা দিগন্তের অনেকখানিই দেখেছেন। 

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়