ছবি : সংগৃহীত

উপমহাদেশের বিখ্যাত গজল শিল্পী গোলাম আলীর কণ্ঠে ‘চুপকে চুপকে রাত দিন আসুঁ বাহানা ইয়াদ হ্যায়’ শোনেননি, এমন গজল প্রেমিক পাওয়া যাবে না। গোলাম আলী মানেই এই গজল এবং এই গজল মানেই গোলাম আলী; যেন একটি আরেকটির পরিপূরক। উপমহাদেশে যেকোনো ভাষার মানুষ, তারা গজলের শব্দের অর্থ বুঝে অথবা না বুঝেও এই গজলের সমঝদার। গান হোক, গজল বা ভজন হোক, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা কাওয়ালি হোক, অধিকাংশ শ্রোতা রাগ, শিল্পীর কণ্ঠ, গায়কি ধাঁচ ইত্যাদির প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হন। কে কোনটি রচনা করেছেন তাদের ব্যাপারে খুব কমসংখ্যক শ্রোতা আগ্রহী হন। ফলে গান, গজল, ভজনের অধিকাংশ রচয়িতা অধিকাংশ শ্রোতার আড়ালেই রয়ে যান। ‘চুপকে চুপকে রাত দিন...’ এর ক্ষেত্রেও যে এটাই সঠিক, তা আমি প্রায় নিশ্চিত বলতে পারি, যদিও গোলাম আলী কোনো অনুষ্ঠানে এই গজলটি গাওয়ার আগে প্রায় প্রতিবার রচয়িতার নাম উচ্চারণ করেন। এই গজল ১৯৮২ সালে নির্মিত বলিউডের ‘নিকাহ’ মুভির অন্যতম সঙ্গীত এবং ‘নিকাহ’ মুভির দর্শকনন্দিত হওয়ার পেছনেও এ গজলের ভূমিকা ছিল। জনপ্রিয় এই গজলের রচয়িতা মাওলানা হাসরত মোহানি, যার পরিচিতির ক্ষেত্র বিস্তৃত। কবি পরিচয়ের চেয়ে তার বড় খ্যাতি ছিল রাজনীতিবিদ হিসেবে। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারতের গণপরিষদের সদস্য, সাংবাদিক ও কবি।

মাওলানা হাসরত মোহানি ১৮৭৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের উননাও জিলার ‘মোহান’ নামে এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা ইরানের নিশাপুর থেকে ভারতে এসে মোহানে বসতি স্থান করেছিলেন। তার পুরো নাম সাইয়িদ ফজল-উল-হাসান। কবি হিসেবে তিনি হাসরত (আকাঙ্ক্ষা) ও তার শহরের নাম যোগ করায় ‘হাসরত মোহানি’ নামেই খ্যাতি লাভ করেছেন। ‘মাওলানা’ যুক্ত হয় সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে। তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এলাকার এক মাদ্রাসায়।

১৮৯৪ সালে মোহান মিডল স্কুল থেকে পরীক্ষায় পুরো রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে আলীগড়ে মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে ভর্তি হন, যে প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে একাধিকবার তার পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ১৯০৩ সালে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি আলীগড় থেকে ‘উর্দু-এ-মুয়াল্লা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ১৯০৪ সালে তিনি বোম্বেতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেস নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের ভক্ত ছিলেন। ১৯০৭ সালে তিলক কংগ্রেস ত্যাগ করলে মাওলানা হাসরত মোহানিও কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯০৮ সালে তার সংবাদপত্র মিশরে ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯১৬ সালে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হলে তিনি ব্রিটিশ আদেশ পালনে অস্বীকার করেন এবং তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তার সংবাদপত্রকে বিপুল অঙ্কের জরিমানা করা হয়। জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তিনি ‘তাজকিরাতুশ শু’রা’ নামে আরেকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ব্রিটিশবিরোধী প্রকাশনার অভিযোগে ১৯২২ সালে তিনি পুনরায় কারাদণ্ড লাভ করেন।

১৯১৯ সালে মাওলানা হাসরত মোহানি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯২১ সালে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন এবং ভারতকে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া’ নামে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণার আহ্বান জানান। তার ভাষণ বাজেয়াপ্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় সহযোগিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু উচ্চতর আদালত তাকে নির্দোষ বলে রায় দেয়।

মাওলানা হাসরত মোহানি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট ভাবধারা তাকে তার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করেনি। ১৯২৩ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আন্দোলন করলেও অবিভক্ত ভারতে বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবি করলে মুসলিম লীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে, যদিও তিনি মুসলিম লীগের মনোনয়নের ১৯৪৫ সালে ইউনাইটেড প্রভিন্স (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) অ্যাসেম্বলির সদস্য ও ভারতের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

ভারত বিভক্ত হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে একমাত্র তিনিই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেননি, কারণ তার মতে সংবিধানে মুসলিম নাগরিকদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে।

রাজনীতির বাইরে মাওলানা হাসরত মোহানির ভালোবাসা ছিল উর্দু সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতায়। তিনি রোমান্টিক কবিতার জন্য বিখ্যাত। কবিতার ওপর তার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে তার ওস্তাদ ছিলেন, খ্যাতিমান উর্দু কবি তসলিম, মোমিন খান মোমিন ও নাসিম দেহলভী। কবিতাকে তিনি জীবনের আয়নায় পরিণত করেছিলেন। প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তার সমসাময়িক কবিদের চেয়ে সাহসী ছিলেন। কবিতায় তিনি আবেগ ও ভাবনাকে আড়াল করে রাখেননি। তার জনপ্রিয় গজলটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গোলাম আলীর গাওয়া গজলে তিনি কিছু শব্দ যোগ করেছেন। পাঠকদের জন্য হাসরত মোহানির মূল গজলটি উপস্থাপন করছি—

‘চুপকে চুপকে রাত দিন আসুঁ বাহানা ইয়াদ হ্যায়

হাম কো আব তক আশিকি কা ও জমানা ইয়াদ হ্যায়।

তুঝসে মিলতে হি ওহ কুচ বেবাক হো জানা মেরা

আওর তেরা দা’তোঁ মে ওহ উঙলি দাবানা ইয়াদ হ্যায়

হাম কো আব তক আশিকি কা ও জমানা ইয়াদ হ্যায়।

খেঁচ লো ও মেরা পরদে কা কোনা দাফতাঁ

আওর দোপাট্টে সে তেরা ও মুঁহ ছুপানা ইয়াদ হ্যায়।

দো-পহর কী ধূপ মে মেরে বুলানে কে লিয়ে

ও তোরা কোঠে পে নাঙ্গে পাওঁ আনা ইয়াদ হ্যায়।

তুঝ কো জব তানহা কভি পা’না তো আজ রাহে-লিহাজ

হাল-এ-দিল বাতো হী বাতো মে জাতানা ইয়াদ হ্যায়

আ গয়া গর ওসল কী শব ভি কাহিঁ জিকর-এ-ফিরাগ

ও তেরা রো রো কে ভি মুঝকো রুলানা ইয়াদ হ্যায়।

বে রুখি কে সাত সুনানা দর্দ-এ-দিল কি দাস্তান

ও কালাই মে তেরা কঙ্গন ঘুমানা ইয়াদ হ্যায়।

ওয়াক্ত-এ-রুখসত আলবিদা কা লফজ কেহনে কে লিয়ে

ও তেরে সুখে লবো কা থর-থরানা ইয়াদ হ্যায়।

আ’হাজারাঁ ইজতিরাব-ও-সদ হাজারাঁ ইশাতিয়াক

তুঝসে ও পহলে পহল দিল কা লাগানা ইয়াদ হ্যায়।

জান কর ছোতা তুঝে ও কাসা-এ-পাবসি মেরা

আওর তেরা ঠুকারা কে সর ও মুস্কুরানা ইয়াদ হ্যায়।

জব সিবা মেরে তুমহারা কোঈ দিওয়ানা না থা

সাচ কাহো ক্যায়া তুম কো ভি ও কারখানা ইয়াদ হ্যায়।

গায়ের কি নজরো সে বাচকর সব মরজি কে খিলাফ

ও তেরা চোরি ছিপে রাতোঁ কো আ’না ইয়াদ হ্যায়।

এখানা মুঝকো জো বারগাশতা তো সো সো নাজ সে

জব মেরা লেনা তো ফির খুদ রুথ জানা ইয়াদ হ্যায়।

চোরি চোরি হাম সে তুম আ কর মিলে থে জিস জাগাহ

মুদ্দতেঁ গুজারিঁ পর আব তক ও ঠিকানা ইয়াদ হ্যায়।

বাওয়াজুদ-এ-ইদ্দা-এ-ইত্তাক্কা হাসরত মুঝে

আজ তক আহাদ-এ-হাওয়াস কা ইয়ে ফাসানা ইয়াদ হ্যায়।'

 

বাংলা অনুবাদ—

'রাত দিন নীরবে তোমার অশ্রু বিসর্জনের কথা আমার মনে আছে

এখনো তোমার প্রেমে পড়ার দিনগুলোর কথা আমার মনে আছে।

তোমার সাথে দেখা হলে আমি সাহস হারিয়ে ফেলতাম,

তুমি তোমার দাঁতে আঙুল কামড়াতে তাও আমার মনে আছে।

আমি হঠাৎ করে পর্দার এক কোণা তুলে ধরতাম

আর তুমি ওড়নায় মুখ লুকাতে তা আমার মনে আছে।

তুমি দুপুরের রোদে আমাকে ডাকার জন্য,

খালি পায়ে আঙিনায় আসতে সে কথা আমার মনে আছে

আমি একা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলে লজ্জিতভাবে

কথায় কথায় আমার হৃদয়ের কথা বলার উপায় বের করতাম,

আমাদের প্রণয়ের রাতে কখনো বিদায়ের কথা উঠলে

তুমি কীভাবে কাঁদতে এবং আমাকে কাঁদাতে তা আমার মনে আছে।

মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তুমি আমার হৃদয়ের ব্যথার কাহিনি শুনতে

আমার মনে আছে কীভাবে তুমি তোমার হাতের চুড়িগুলো ঘোরাতে।

যখন বিদায়ের বাণী উচ্চারণ করা সময় হতো

তোমার শুকনো ঠোঁট কীভাবে কেঁপে উঠতো তা আমার মনে আছে।

হাজারটি উদ্বেগ এবং হাজারটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে

কীভাবে তোমার কাছে প্রথম হৃদয় হারিয়েছিলাম তা আমার মনে আছে।

আমি জেনে-বুঝে পূজা করার মতো তোমার পা স্পর্শ করতাম

কীভাবে তুমি মাথা নেড়ে হাসতে তা আমার মনে আছে

আমি ছাড়া যেহেতু তোমার আর কোনো প্রেমিক ছিল না

তাহলে সত্যি বলো, তোমার কি সেই মুহূর্তগুলো মনে আছে?

অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে

তুমি লুকিয়ে রাতে আমার কাছে আসতে তা আমার মনে আছে। 

আমাকে তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখলে তুমি কোমলভাবে

মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলিয়ে তুমি নিজেই রাগ করতে তা আমার মনে আছে।

তুমি সবার চোখ এড়িয়ে যে জায়গায় আমার সঙ্গে মিলিত হতে

বহু বছর গত হলেও এখনো সে জায়গার কথা আমার মনে আছে।

হাসরত, তোমার সংযমের সকল দাবি সত্ত্বেও

আকাঙ্ক্ষার ওই দিনগুলোর কথা এখনো আমার মনে আছে।

তিনি তার অনেক কবিতায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকেও তুলে এনেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তার একটি কবিতায় বলেছেন,

‘আখোঁ মে নূর-ই-জলওয়া-ই-বে-কাইফ-ও-কাম হ্যায় খাস

জব সে নজর পে উনকি নিগাহ-ই-করম হ্যায় খাস,

কুচ হাম কো ভি আতা হো কি এ্যয় হযরত-ই-কৃষণ

ইকলিম-ই-ইশক আপ কে জের-ই কদম হ্যায় খাস

হাসরত কি ভি কুবুল হো মথুরা মেঁ হাজিরি

সুনতে হ্যায় আ’শিকোঁ পে তুমহারা করম হ্যায় খাস।’

অর্থ—

'যখন সে তার উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার পানে তাকায়

আমার চোখ নামহীন বিশেষ আলোতে জ্বলে ওঠে।

শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণ, আমার ওপরও কিছু বর্ষণ করে ধন্য করো,

কারণ তোমার পদতলেই বিরাজ করে প্রেমের সাম্রাজ্য

তুমি মথুরায় হাসরতের উপস্থিতিও গ্রহণ করে নাও,

শুনেছি, প্রেমিকদের প্রতি তোমার অনেক অনুগ্রহ।'

তার জীবনের এমন একটি পর্যায় ছিল যখন তার প্রিয় প্রতীকে পরিণত হয়েছিল মক্কা, মথুরা ও মস্কো। জানা যায় যে, তিনি এগারো বার হজ্ব করেছিলেন। পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে তিনি কোনো দ্বন্দ্ব দেখতেন না। যে ধার্মিক নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি মক্কায় গেছেন, একই ধরনের আন্তরিকতায় মথুরায় গিয়ে কৃষ্ণের শিক্ষা ও দর্শন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রশংসা করলেও তার কিছু আদর্শ ও পন্থাকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি গান্ধী ও লেনিনকে এভাবে তুলনা করেছেন,

‘গান্ধী কি তরহ ব্যয়ঠ কে কাটেঙ্গে কিউঁ চরখা,

লেনিন কি তরহ দেঙ্গে না দুনিয়া কো হিলা হাম?'

(গান্ধীর মতো চরকা কেটে সময় নষ্ট করছো কেন

কেন লেনিনের চেতনায় বিপ্লব সৃষ্টি করছো না?)

মাওলানা হাসরত মোহানি ১৯৫১ সালে লক্ষ্মৌতে মৃত্যুবরণ করেন। তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ও তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভারত ও পাকিস্তানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।। সাংবাদিক