ছবি : সংগৃহীত

আমাদের ছোটবেলায় সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তু ছিল টেলিভিশন। বিকেল পাঁচটায় উন্মোচিত হতো তার পর্দা। তবে তার আগেই ‘ঝিরঝির’ করা শূন্য পর্দার দিকে তাকিয়ে থেকে শুরু হয়ে যেত ধৈর্যের পরীক্ষা। টিভিসেটের সামনে আকুল হয়ে বসে থাকা ছিল আমাদের অভ্যাসের অংশ। ওই সময় অনেকগুলো মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল; তাদের একজন মমতাজউদদীন আহমদ।

কমিক চরিত্রে উচ্ছল অভিনয় করতেন, কোনো নাটকে থাকত পাগলাটে ভঙ্গি। প্রধান চরিত্রে খুব বেশি অভিনয় করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না; কিন্তু অপ্রধান চরিত্রগুলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতেন তিনি। আমার ভালো লাগত। আশি-নব্বইয়ের দশকে হুমায়ূন আহমেদের বেশকিছু নাটকে তাকে দেখেছিলাম। একবার একটি নাটকে বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন প্রাইভেট টিউটর। মমতাজউদদীন আহমদ অত্যন্ত স্ত্রী ভীত। কারণ কন্যা পরীক্ষায় ফেল করেছে। বাবার চরিত্রে দারুণভাবে মানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মমতাজউদদীন আহমদের অবস্থান আরও বিশদ। খোলা চোখে হয়তো ধরাই যায় না; হয়তো জানাই যায় না যে, আগাগোড়া সৃষ্টিশীল এই মানুষটি জড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশের মর্মের সঙ্গে। ডুগডুগি বাজানো গণমাধ্যম তার ওপর খুব বেশি আলো ফেলেছে বলেও মনে হয় না। অথচ ইতিহাসের পাতাগুলো হালকা সরিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, বাঙালির জাতীয়তাবাদের ধ্রুপদি বুদ্ধিজীবীতার সেরা নজিরগুলোর একজন তিনি। 

একই ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে বহু ভূমিকায়। তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শরিক জন। তিনি নাটক লিখছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। মঞ্চ বা টিভি, দু’দিকেই মেলে ধরছেন সৃজনশীলতার প্রান্ত। নাট্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মমতাজউদদীন আহমদের অবস্থান আরও বিশদ। তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শরিক জন। তিনি নাটক লিখছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। মঞ্চ বা টিভি, দু’দিকেই মেলে ধরছেন সৃজনশীলতার প্রান্ত। নাট্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি।

হুমায়ূন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আফজাল হোসেনের মতো মঞ্চ ও টিভি কাঁপানো তারকা শিল্পীরা অভিনয় করেছেন মমতাজউদদীন আহমেদের নাটকে। এমনকি তিনিই লিখছেন পাঠ্যবই। এ তথ্য হয়তো অনেকেই জানি না, বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ। বলা যায়, যেসব উপাদানের সহযোগে একটি রাষ্ট্র ও জাতি সংগঠিত হয়ে থাকে, তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। 

নাটক দিয়েই আমরা তাকে বিশেষভাবে চিনি। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে ভাষা আন্দোলনমুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক লিখেছেন তিনি। এ তালিকায় আছে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম’, ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘কী চাহ শঙ্খচিল’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’। লোকনাট্যের রীতি অনুসরণে লিখেছেন ‘রাজা অনুস্বরের পালা’। ছোট নাটকগুলোর মধ্যে বিখ্যাত ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’, ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’ ইত্যাদি। প্রতিটি নাটকে তিনি দেশ-কাল সচেতন। সামরিক শাসনের সময় আলোড়ন তুলেছিল তার ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’ নাটকটি। 

মমতাজউদদীন আহমদের ভাবনার বড় একটি স্থান জুড়ে আছে শিশু-কিশোর। ছোটদের জন্য লিখেছেন অনেকগুলো নাটক। সম্ভবত বুঝেছিলেন, কিশোর মনস্তত্ত্বের রূপান্তর ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ।

বাংলাদেশে শিশু-কিশোর নাট্যধারার রুগ্ন প্রান্তরে তিনি হয়তো কলস্বর শোনাতে চেয়েছিলেন। সাংস্কৃতিকভাবে তিনি কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি, কিশোর নাট্যকর্মী ও অভিনেতার পরিপোষণ ছাড়া ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না।

প্রশ্ন হলো, ভাবাদর্শিকভাবে মমতাজউদদীন আহমদের অবস্থান কী? বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র —দেশ চেতনার এই প্রধান নৈতিক শক্তিগুলোই তার অবলম্বন। অধিকাংশ নাটকে নানা পদ্ধতিতে তিনি এই উদার মানবিকতাবাদী উপাদানগুলোকেই বিষয় হিসেবে হাজির করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের পটভূমিতে যারা সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন তাদের অনেকেরই মৌল বৈশিষ্ট্য এই স্বদেশ চেতনা। মমতাজউদদীন আহমদকে পাঠ করতে পারি এরই প্রেক্ষাপটে। 

নাটক ছিল তার নিত্যদিনকার চর্চা ও চর্যার অংশ। ব্যক্তিগত একটি স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘নাটক আমাকে দিনরাত্রির অনেক সময় সঙ্গ দেয়। সবুজ যেমন পাতাকে, নীল যেমন আকাশকে আর উত্তাল তরঙ্গ যেমন মহাসাগরকে ঘিরে থাকে, তেমনি নাটক আমাকে জড়িয়ে রাখে।’

প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের পটভূমিতে যারা সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন তাদের অনেকেরই মৌল বৈশিষ্ট্য এই স্বদেশ চেতনা। মমতাজউদদীন আহমদকে পাঠ করতে পারি এরই প্রেক্ষাপটে।

নাট্যচর্চার দীর্ঘ পথরেখায় তিনিও ইউরোপ দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু মনের ভেতর তৈরি হয়েছিল ওই সচেতনতা, কেন ইউরোপ? গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফের আগে কি বাংলা নাটক ছিল না? আত্মজিজ্ঞাসায় শামিল হয়েছেন এই বলে, ‘বিশাল পণ্ডিত ও গবেষকরা বাংলা নাটককে ইউরোপীয় প্রসেনিয়ম থিয়েটারের বাইরে আর কোথাও খুঁজে পান না।’ অথচ খুঁজে দেখবার অজস্র জায়গা আছে।

মমতাজউদদীন আহমদও নাটকের মূল শক্তিগুলোকে খুঁজতে চেয়েছেন বাংলার মাটিতে। কিন্তু কলকাতার মুখ পানে চেয়ে থাকার ঝোঁকটিও তার পছন্দ হয়নি। বলেছেন, আমরা আসলে নিজেদের মাটি খুঁড়ে দেখতে শিখিনি। পরিশ্রমের কাজ করতে শিখিনি। ব্যঙ্গের সুরে বলেছেন, ‘কলকাতা ওয়ালারা আগে করুক, তারপর টিকিট করে দেখে এসে মহিলা সমিতিতে চালিয়ে দেব।’ এই উক্তি বাংলাদেশি মনস্তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রবণতাকে তুলে ধরে।

বাঙালি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে তিন পশ্চিম থেকে বেরুতে পারেনি—ইউরোপ, আরব অঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গ; এই তিনই তার প্রণম্য এলাকা। মমতাজউদদীন আহমদ চিন্তার মোড় ফেরাতে চেয়েছেন ভিন্ন দিকে। চিন্তার দিক যদি স্থির করতেই হয়, তাহলে নিজের দিকেই আগে তাকাও হে বাপু; তাকাও নিজের দেশ, মাটি ও অঞ্চলের দিকে। আবার, প্রয়োজনে অঞ্চলকে ছাড়িয়ে যাও। কোথায়? ক্লাসিকতার চত্বরে।

মমতাজউদদীন আহমদ ধ্রুপদি চেতনাকে করে তুলেছেন কিশোর মনস্তত্ত্বের উপযোগী। মনে পড়ে, নব্বই-আশির দশকের বাংলা সহপাঠ বইগুলোর জন্য রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, শাহানামা থেকে কাহিনি নিয়ে গল্প লিখেছেন মমতাজউদদীন আহমদ।

মমতাজউদদীন আহমদের খুব আকর্ষণীয় দিক এই ক্লাসিকতা—ধ্রুপদি বা ক্লাসিক সাহিত্য প্রেম। বাংলাদেশের সাহিত্য অধ্যয়নের পটভূমি থেকে যেটি প্রায় পদধূলি নিয়ে বিদায় নেওয়ার পথে। অথচ পঞ্চাশ ও ষাটের অনেক কবি লেখকই ক্লাসিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অনুপ্রেরণার উৎস স্থল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ষাটের গদ্যকার হায়াৎ মামুদের ভেতর এই চেতনার সাক্ষাৎ পাই আমরা। মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের পর ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় মোহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন, জীবন সম্পর্কিত গভীর দৃষ্টির খোঁজে আমাদের যেতে হবে ধ্রুপদি সাহিত্যের কাছে। প্রায় একই ধরনের কথা বলতেন নাট্যকার সেলিম আল দীন। তাদের চোখে অবক্ষয়বাদ ও আধুনিকতা থেকে মুক্তির উপায়ও ছিল ধ্রুপদি সাহিত্য।

মমতাজউদদীন আহমদ ধ্রুপদি চেতনাকে করে তুলেছেন কিশোর মনস্তত্ত্বের উপযোগী। মনে পড়ে, নব্বই-আশির দশকের বাংলা সহপাঠ বইগুলোর জন্য রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, শাহানামা থেকে কাহিনি নিয়ে গল্প লিখেছেন মমতাজউদদীন আহমদ।

ফেরদৌসীর শাহনামা নিয়ে লিখেছেন পূর্ণাঙ্গ একটি বই। এ বই কেবল কিশোর নয়, তৃপ্ত করবে তাকেই, যিনি প্রবেশ করতে চান জীবন উপলব্ধির গভীর দুয়ারে। বইটির বিভিন্ন অংশে জুড়ে দিয়েছেন ফারসি উদ্ধৃতি। চাইলেই কেউ নিতে পারেন ফারসি স্বাদ। বিভিন্ন সংস্কৃতির মহাকাব্যের গল্প নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘জগতের যত মহাকাব্য’ নামের বই। কেন লিখলেন এরকম বই? আবহমান জীবনের উপলব্ধিগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার আর কোনো শিল্পিত উপায় হয়তো নেই। শেক্সপিয়রের প্রতি তার মুগ্ধতার কারণও সেই জীবনদর্শন কিংবা জীবন উপলব্ধি।

ছোট্ট একটা দৃশ্য মনে পড়ে। আম্মা পড়াচ্ছেন। অসুস্থ মোড়লের জন্য লাগবে সুখী মানুষের জামা। কোথায় পাওয়া যাবে সেই সুখী মানুষ? খুব কৌতূহলী হয়েছিলাম, সুখী মানুষ দেখতে কেমন? খুঁজে পেতে দেখা মিলল এক কাঠুরের; সে-ই কি না সুখী; কিন্তু তার গায়ে কোনো জামা নেই। আমার চোখের সামনে স্থায়ীভাবে মুদ্রিত হয়ে গেছে এই দৃশ্য, সুখী মানুষের কোনো জামা নেই। ক্লাস ফোরে পড়া এই লেখাটির রচয়িতা মমতাজউদদীন আহমদ। 

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়