ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুর মানের তালিকায় আধিপত্য বজায় রেখেছে। বৈশ্বিক বায়ু মান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক দিন থেকে ঢাকা পৃথিবীর দূষিততম নগরীগুলোর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকছে। 

এই অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া— কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। 

বায়ু দূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী অক্ষমতা এবং মৃত্যুর জন্য শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ু শ্বাস নেওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে। মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। 

বায়ুদূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। 

বায়ূ দূষণের জন্য শ্বাসকষ্ট ছাড়াও ফুসফুস জনিত সমস্যা, পেটের সমস্যা, ত্বকের সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জিজনিত সমস্যা, চোখের সমস্যা, যেকোনো সংক্রমণ, গর্ভকালীন সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলে। 

নিপসম (জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান)-এর ২০২০ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৪৯ ভাগ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর বাতাসে সাধারণত ধুলা ও দূষণ বেড়ে যায়। 

যানবাহন ও শিল্প কারখানার ধোঁয়া; বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলায় আবর্জনা, কেরোসিন ও কাঠ-কয়লা দিয়ে রান্নার ধোঁয়া; ইটভাটা; ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা ও চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলা বায়ূ দূষণের অন্যতম কারণ। এগুলোর পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্যও এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে। 

গত বছর বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন। এতে বলা হয়, “বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ওই ধূলিকণাসহ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ওই দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।” প্রতিবেদনটিতে পরিষ্কারভাবে আরও বলা হয়, “ভারতের কলকাতা, মুম্বাই, পাকিস্তানের করাচি ও বাংলাদেশের ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালিও বাতাসে মিশছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ওই শহরগুলো এই অঞ্চলের বায়ুকে দূষিত করে ফেলছে।” 

ঢাকা শহরে যে যানবাহনগুলো চলে সেগুলো বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যাও কম নয়। গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়। উন্নত দেশগুলো ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরোনো গাড়ি বাতিল করে দেয়। উন্নত দেশগুলো গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে এর সালফারের মাত্রা ৫০-এর নিচে। আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর উপরে। তারা ভালো মানের জ্বালানি ব্যবহার করে। তারা ঠিকভাবে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করে, আমরা তা করি না। ফলে আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর দূষণ হয়। শুধু তাই নয়, বিকল্প যানবাহন দূষণ কমায়। ট্রাম বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। মেট্রোরেল ও ইলেকট্রিক কার দূষণ কমায়। 

বাংলাদেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজ চলতে থাকে। কাজে ব্যবহৃত মালপত্র ঢেকে রাখা হয় না। উন্নত বিশ্বে নির্মাণকাজ বিশেষভাবে ঢেকে এবং কম সময় নিয়ে করা হয়। এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় সারা বছর ধরে এবং মাটিগুলো রাস্তার পাশেই রাখা হয়। ওগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে গার্মেন্টস এবং শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায় ব্যাপকভাবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ঢাকার আশপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেগুলো দূষণের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। অনেক দেশে ইটভাটা নেই। তারা সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করে। আমরাও ব্লক ব্যবহার করতে পারি। 

আমাদের এখানে গৃহের ভেতর দূষণ (ইনডোর এয়ার পলুশন) বেশি হয়। আমরা স্বাস্থ্যসম্মত রান্নাঘর ব্যবহার করি না বলে আমাদের রান্নাঘর থেকেও প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এসব বিষয়ে যদি আমরা সচেতন হই তাহলে দূষণ কম হবে। কাজগুলো অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে। এ জন্য সরকারি পর্যায় থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

বায়ু দূষণের কারণগুলোই বলে দিচ্ছে এ দূষণ কমানো বা রোধ করা সম্ভব। কিছু নিয়ম, কিছু পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগই কমাতে পারে বায়ু দূষণ। শুধু স্থানীয়ভাবে ঢাকায় বায়ুদূষণ কমালে কাজ হবে না। এ জন্য আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করার বিষয়ে আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সকল দেশের একমত হওয়া প্রয়োজন। না হলে এই অঞ্চলের কোনো দেশের বায়ু দূষণমুক্ত হবে না। তাই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য এসব দেশের সরকারপ্রধানদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম। 
professorkabirul@gmail.com

এইচকে