২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব ভারতীয় জাতীয় পার্টি-বিজেপি’র বিরাট বিজয়ের পর দক্ষিণ এশিয়ার পত্রিকা ‘হিমাল’-এ সুকুমার মুরলীধরন এক প্রবন্ধে লিখে বলেছিলেন, ‘এ বারের ভোটে কর্পোরেট বিজ্ঞাপনদাতারা এবং বিজেপি’র মিডিয়া কৌশল এক ধরনের ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড কনসেন্ট’ তৈরি করেছে’। এর মানে হল, কর্পোরেট সংস্থাগুলো সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করেছে নির্বাচনের পক্ষে।

এ নিয়ে নানা বিতর্ক করা যাবে। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, আমাদের মতো দেশেও অন্যান্য দেশের মতো ব্যক্তিখাতের বড় পুঁজি প্রবেশ করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ায় গণমাধ্যম মালিকানার সামন্ত প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারলেও বাংলাদেশে কনটেন্টের মালিক আসলে মালিকরাই। একটা সময় অল্প অল্প করে মালিকরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে গণমাধ্যমকে কিছু কিছু করে ব্যবহার করলেও এখন সেটাই কোনও কোনও গণমাধ্যমের মূল কাজ। এর সাথে নতুন করে বড় আকার যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ। ফলে অনেক শিক্ষাবিদই বলে থাকেন, ‘সম্পাদকরা আসলে কর্পোরেট এডিটোরিয়াল ম্যানেজার’। সাংবাদিকরা হলেন কর্পোরেট এডিটোরিয়াল এক্সিকিউটিভ। কর্পোরেট পলিসি ও সম্পাদকীয় নীতিতে কোনও পার্থক্য নেই। সাংবাদিকরা সেই নীতির বাস্তবায়ন করেন সাংবাদিকতার নামে।

দু’একটি বাদ দিলে গণমাধ্যম হাউজগুলোর কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। তাই তারা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষাও দিতে পারে না।

তাই বাংলাদেশের মতো দেশে গণমাধ্যমের আলোচনায় বস্তুনিষ্ঠতা আর নিরপেক্ষতার আলোচনা সত্যিকার অর্থে এক কঠিন কাজ। জীবনভর রাজনৈতিকরা, আমলারা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলে এসেছেন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিককে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ, পক্ষপাতহীন, ভারসাম্যপূর্ণ এবং তাদের সব কাজে থাকবে ন্যায্যতা। কিন্তু এসব পরিভাষার সাথে নিরপেক্ষতার সম্পর্ক সৃষ্টি করাটা বেশ কঠিন।

যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মাধ্যমের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। সাংবাদিকরা সেখানে কাজও করেন। তাহলে তারা কি সেখানে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন? মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরাসরি রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সমর্থিত সাংবাদিকতা দেখেছি আমরা। ২০২০ সালের শুরুর দিকে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ “পলিটিক্যাল পোলারাইজেশন এন্ড মিডিয়া হ্যাবিটস” শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে বলেছে, ‘গত পাঁচ বছরে মার্কিন গণমাধ্যমের রাজনৈতিক মেরুকরণ যেভাবে ঘটেছে তা আগে কখনও ছিল না। এবং এই পক্ষপাতিত্বের বড় অংশই উপভোগ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল এবং এই দলটিই মিডিয়াকে রাজনৈতিকভাবে বেশি প্রভাবিত করেছে।’

বস্তুনিষ্ঠতা মানে হল কোনও ঘটনাকে বা বিষয়কে বাড়িয়ে বা কমিয়ে না বলা। রিপোর্টারের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ যাই থাক কোনও মন্তব্য থাকবে না রিপোর্ট-এ। ঘটনা এবং বিষয়ে অনিবার্যভাবে একাধিক পক্ষ থাকে। পক্ষপাতহীনতা মানে সাংবাদিক কোনও পক্ষে নেই এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সব পক্ষের কথা তথ্যের মধ্যে দিয়েছেন। ন্যায্যতা মানে দুজনের দাবিই যত ন্যায্য ভাবে সম্ভব তুলে ধরে রিপোর্ট করা।

কিন্তু নিরপেক্ষতা? তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদনের গঠন এবং রিপোর্টারের নিজস্ব বর্ণনা সব কিছু ঘটনার সাথে জড়িতদের অবস্থান থেকে দূর এবং স্বতন্ত্রভাবে করতে হবে। সাংবাদিককে নিরপেক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সাংবাদিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় চেতনা। এখানে সাংবাদিককে অবস্থান নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সাংবাদিকতার মূল আদর্শই হল ভিন্ন পরিসরে ভিন্ন মতামত সংগ্রহ করা এবং তা যাচাই করে পরিবেশন করা। এগুলো সবই স্বাভাবিক চ্যালেঞ্জ গণমাধ্যমের জন্য। কিন্তু গণমাধ্যমের এখনকার চ্যালেঞ্জটা আরও অন্যরকম।

সব মূলধারার মিডিয়া যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে সেটা হলো, নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখা। এই প্রজন্ম টিভির খবর শুনতে অনাগ্রহী। তাদের জন্য দরকার এমন ব্যবস্থা করা, যাতে তারা তাৎক্ষণিকভাবে সব খবর জানতে পারে। তাদের জন্য মোবাইলে খবরটা দিতেই হবে। অপেক্ষায় থাকা চলবে না, আবার একই সঙ্গে সেই তথ্য হতে হবে সঠিক। সামাজিক মিডিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে সারাক্ষণ।

আইনসম্মত ও আইন-বহির্ভূত, সকল উপায়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের আয়োজন আছে এ দেশে। সাংবাদিকদের হত্যা করা, নির্যাতন করা, জেলে দেওয়া বহুগুণ বেড়েছে এখন।

আমরা জানি রাজনৈতিকরা, আমলারা এবং বিজ্ঞাপন দাতারা গণমাধ্যমকে তাদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়, কখনও কখনও এরা গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম কর্মীদের জীবনও বিপন্ন করে তোলে। এখানেই প্রাসঙ্গিক গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিকতা। আমাদের দেশে দু’একটি বাদ দিলে গণমাধ্যম হাউজগুলোর কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। তাই তারা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষাও দিতে পারে না। রাজনৈতিকদের ক্রোধ আর চতুরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার মর্যাদা সাহসের সঙ্গে বজায় রাখতে হবে প্রতিষ্ঠানকেই। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য এটাই সত্য। মিডিয়া প্রাতিষ্ঠানিক না হলে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত না হলে রাজনৈতিকদের সাথে আপস করে গণমাধ্যম মালিকরা এবং রাজনৈতিকভাবে বিবর্জিত ইউনিয়নের নেতারা।

সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে সরকার। এতে বিরক্তি আসতে পারে, তবে নূতনত্ব কিছু নেই। আদিকাল থেকে এটাই করে আসছে তারা। আমাদের  সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দিয়েছে। সংবাদের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার। সরকার কিংবা বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, তাদের কাজের নজরদারি করা, তার সাফল্যের বিচার করা সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। এখন তারাই সংবাদমাধ্যমের বিচারক সেজে বসলে বা কনটেন্টের মালিক হয়ে গেলে সাংবাদিকতা বিপন্ন হয়।

আইনসম্মত ও আইন-বহির্ভূত, সকল উপায়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের আয়োজন আছে এ দেশে। সাংবাদিকদের হত্যা করা, নির্যাতন করা, জেলে দেওয়া বহুগুণ বেড়েছে এখন। সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা এতটাই নাজুক যে, সরকারি প্রকল্পের অর্থ বা চাল-ডাল চুরি দেখালেও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সাংবাদিক সমাজ এর প্রতিবাদও করতে পারছে না।

সাংবাদিকতা যেহেতু পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর তাই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনায় এসব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করেই আমাদের ভাবতে হবে কতটা ভাল সাংবাদিকতা আমরা করতে পারব। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা একটা নিরন্তর লড়াইয়ের ভেতর থাকেন সাংবাদিকতা করার জন্য। বাইরে তার জন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ, ঘরে সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ।

তবুও বলবনা সাংবাদিকের দিন ফুরিয়েছে। দিন যায়নি। সাংবাদিকদের ভূমিকা জরুরি, কারণ গণতন্ত্রের মূল উপাদানের একটি হল মানুষের তথ্য পাবার অধিকার এবং সে কাজটি করে সংবাদ। প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ইন্টারনেট। নিখরচায় মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে তথ্য। তবুও সাংবাদিকতা থাকবে, থাকবে বস্তুনিষ্ঠতার চ্যালেঞ্জ। দরকার সাংবাদিকের লড়াকু মন, গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিকতা আর গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের সহযোগিতা।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

ishtiaquereza@gmail.com