একজন শিক্ষকের রুচিবোধ কতখানি প্রশ্নবিদ্ধ হলে তিনি সন্তানসম শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ উক্তি করেন, তা সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন। একজন ‘শিক্ষক!’ যখন রাতে চলাফেরার সাথে নারীর বিয়ে হওয়া না-হওয়া নিয়ে কুৎসিত বয়ান দেন, যখন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করেন, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের জন্য এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে দিনের পর দিন আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। 

শিক্ষার্থীদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন শুধু উপাচার্যের পদত্যাগের জন্যেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারী শিক্ষক, প্রভোস্টসহ প্রশাসনের নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের এই প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী আমরণ অনশন পর্যন্ত করেছেন। এই কিছুদিন আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইয়াসমীন হক ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের অনুরোধে জীবনসংকটে থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের অনশন ভাঙেন। কিন্তু দাবি-দাওয়া এখনও পূর্ণ হয়নি, তাই শিক্ষার্থীরাও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন আর তাদের পাশে শুভ-বোধসম্পন্ন মানুষদের দেখে আমরাও হতাশ হতে হতে আবার আশাবাদী হয়ে উঠি। প্রজন্মের সাহস আমাদের ন্যায়ের পথ দেখায়। আপসরফার সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেই তারা অনড় থাকে তাদের আদর্শে। 

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেরই শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে আন্দোলন চলাকালীন, তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এবং ফিরে এসে তারা আবার আন্দোলনে সামিল হয়েছে। 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতাই নয়, উপাচার্যের নারীর বিরুদ্ধে কটূক্তি ও অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিবাদেও শামিল হয়েছেন প্রগতিবাদী মানুষ। নারীর অধিকারকে খর্ব করে আজও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বহাল আছে সূর্যাস্ত আইনসহ নানা ধরনের বৈষম্যমূলক নিয়মকানুন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের ছবিতে, ভিডিও আর খবরে যখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো উত্তাল, ঠিক সেই সময়ই, অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি থেকেই আরও কিছু ছবি সামাজিকমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। 

এই ছবিগুলোর মাধ্যমে আমরা দেখি দুজন শিল্পীর শিল্পসত্তার যূথবদ্ধ শক্তি। একজন আলোকচিত্রশিল্পী এবং একজন নৃত্যশিল্পীর প্রতিভার যৌথ প্রয়াসে আলোকচিত্রগুলোতে কী অপূর্ব ফুটে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের উদ্বেলিত প্রতিবাদের ভাষা। নারীর শক্তি আর নৃত্যশিল্পীর আকাশে উড়ন্ত নৃত্য ভঙ্গিমার দৃশ্যগুলো যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে- এই অপরাহত দৃশ্যায়ন যেন নারীর বিরুদ্ধে সকল অপমানজনক বক্তব্যের মুখে প্রতিবাদের চপেটাঘাত। বাংলার আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থান যেমন- কার্জন হল, খেলার মাঠের সামনের পথ, টিএসসির মোড়ে আর রাজু ভাস্কর্যের সামনে পাশ্চাত্যের ব্যালে নৃত্যের ভঙ্গিমায় কখনো আকাশে উড়ছেন তারুণ্যের নারী, কখনো বা শুধুমাত্র বুড়ো আঙুলে মাটি একটুখানি ছুঁয়ে শূন্যে পা ছুঁড়ে উচ্ছ্বাসে মেতেছেন এই তরুণ শিল্পী। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহনকারী দুই বাসের মাঝে দুঃসাহসী নান্দনিক ভঙ্গিমায় নিজের অন্তর্গত শক্তিকে মেলে দিয়েছেন শূন্যে। 

যখন একটি অস্থির সময় পার হচ্ছি আমরা, আমাদের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিজেদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন, যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য গাভী বৃত্তান্তের প্রহসনকেও ছাড়িয়ে গেছেন, তখন নৃত্যশিল্পী মোবাশ্বিরা কামাল ইরার এই অপূর্ব ব্যালেভঙ্গিমা যেন আমাদের মগজের বন্দিত্বে আনে হাতুড়ির আঘাত। কেবল নৃত্যশিল্পী ইরার প্রতিভার অনন্যতাই নয়; এর সঙ্গে যুগলবন্দি হয়েছে আলোকচিত্রশিল্পী জয়িতা আফরিনের ক্যামেরার চোখ। রাজু ভাস্কর্যের সামনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাখা প্ল্যাকার্ডগুলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে কী অপূর্ব শক্তি বিন্যস্ত করা হয়েছিল প্রতিটি ফ্রেমিংয়ে। দৃশ্যের সুষমা থেকে বেরিয়ে আসা আগুন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আলোকচিত্রশিল্পী জয়িতা তৃষা একজন ক্যানসারজয়ী শিল্পী। জীবনের আশ্চর্য শক্তিকে তিনি কী অসামান্যতায় ব্যবহার করেছেন তার প্রতিটি ফ্রেমে, প্রতিটি ক্লিকে। আমি আলোকচিত্রী নই, তবে আলোকচিত্রের একজন মুগ্ধ দর্শক হিসেবে ছবিগুলো যতবার দেখেছি, ততবারেই মনে হয়েছে- কেবল একটি নয়; নানা আঙ্গিকের নানা বার্তা যেন ছবিগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে। এজন্যই বোধ হয় বলা হয় A picture is worth a thousand words.

আমাদের আন্দোলনের মাঠে, বোধের পাঠশালায় আর চিন্তার বৈঠকে আলোকচিত্রী জয়িতার তোলা নৃত্যশিল্পী ইরার এই ব্যালেভঙ্গিমা নতুন আগুনের সন্ধান দেবে। নারীর শক্তি আর মুক্তির ভাষ্যে এ এক নব অনুবাদ। 

এইচকে