কৃষক দলের কমিটি গঠনে জটিল সমীকরণে বিএনপি
দীর্ঘ ২২ বছর পর বিএনপির অঙ্গসংগঠন কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন দিন পার হয়ে গেলেও নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। আরও কতদিন নতুন নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে জানে না সংগঠনটির নেতারা। তারা বলছেন- কাউন্সিলররা সংগঠনের আগামী দিনের নেতা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। এখন তাকেই ঠিক করতে হবে, সংগঠনের বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ দুই নেতাকে রেখে আগামী কমিটি ঘোষণা করবেন, নাকি নতুন কাউকে আনবেন।
কৃষক দলের নেতারা বলছেন, ২২ বছর পর গত ১২ মার্চ কৃষক দলের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে। সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেন। একই সঙ্গে নেতৃত্ব নির্বাচনের দ্বিতীয় অধিবেশনের জন্য কাউন্সিলরদের গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে সারা দেশের কৃষক দলের ৭৯টি সাংগঠনিক জেলার ৫ জন করে ৩৯৫ জন কাউন্সিলর আগামী দিনে সংগঠনের নেতা নির্বাচনে তাদের মতামত তুলে ধরেন। লন্ডন থেকে স্কাইপে এতে যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিজ্ঞাপন
কাউন্সিলররা নেতা নির্বাচনে তাদের মতামত দিলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেন তারেক রহমানকে। কিন্তু সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ভেঙে দেওয়া আহ্বায়ক কমিটির ১৫৩ জন পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচনে তাদের মতামত দিতে পারেননি। কারণ, কাউন্সিলরদের যে তালিকা ভেঙে দেওয়া আহ্বায়ক কমিটির সচিব কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন দিয়েছেন, সেখানে এই ১৫৩ জনের নাম তিনি দেননি। কথিত রয়েছে ভেঙে দেওয়া আহ্বায়ক কমিটিতে আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদুর অনুসারী বেশি। কিন্তু আগামীতে দুদু থাকুক, এটা চান না তুহিন। এই কারণে তিনি কাউন্সিলরের তালিকায় তাদের নাম রাখেননি। ফলে, সব মিলিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে গিয়ে জটিল সমীকরণের মধ্যে পড়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। এই জন্য নতুন কমিটি ঘোষণা দিতে দেরি হচ্ছে।
উপজেলা কমিটি গঠন করবে জেলা কমিটি, আর জেলা কমিটি গঠন করবে কেন্দ্রীয় কমিটি। আর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করবে বিএনপির চেয়ারপরসন। এর বাইরে আর কিছু বলা নেই। ফলে, নেতা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ কোথায়?
হাসান জাফির তুহিন
বিজ্ঞাপন
কৃষক দলের ভেঙে দেওয়া আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১২ মার্চ সম্মেলন শেষ করতে রাত ১২টা বেজে যায়। আর গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষ হয়েছে রাত সাড়ে ১১টায়। এই কারণে গত দুইদিন কমিটি হয়নি। আমরা আশা করছি, আজকে কমিটি হতে পারে।
আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের নাম তালিকায় না রাখা এবং এ নিয়ে সংগঠনের গঠনতন্ত্র কী বলে জানতে চাইলে হাসান জাফির তুহিন বলেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্রে বলা আছে- উপজেলা কমিটি গঠন করবে জেলা কমিটি, আর জেলা কমিটি গঠন করবে কেন্দ্রীয় কমিটি। আর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করবে বিএনপির চেয়ারপরসন। এর বাইরে আর কিছু বলা নেই। ফলে, নেতা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ কোথায়?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ১২ তারিখ রাতে কৃষক দলের সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে কাউন্সিলরদের অধিকাংশ আগামী কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হাসান জাফির তুহিনের নাম প্রস্তাব করেছেন। তার পাশাপাশি অনেক কাউন্সিলর সভাপতি হিসেবে শামসুজ্জামান দুদুরও নাম প্রস্তাব করেছেন তারেক রহমানের কাছে। এখন তারেক রহমান দলের স্থায়ী কমিটির নেতাসহ অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে কৃষক দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন।
বিএনপির সূত্র জানায়, কৃষক দলের নতুন কমিটি ঘোষণায় আরও কয়েকদিন দেরি হতেও পারে। কারণ, সদ্য ভেঙে দেওয়া বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ দুই নেতা শামসুজ্জামান দুদু আর সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন ইতোমধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের রেখে কমিটি হলে আগামীতে দুজনের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে, যা সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অন্যদিকে গত ২৭ বছর ধরেই কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুজ্জামান দুদু। সেই ক্ষেত্রে আগামী কমিটিতে হাসান জাফির তুহিনকে সাধারণ সম্পাদক করা হলে সভাপতি পদের জন্য কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। এরমধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম এগিয়ে আছেন। তবে বিএনপির একটি অংশ চায়, দুদুকে বাদ দেওয়া হলে সভাপতি পদে যেন ৯০ দশকের ডাকসুর ছাত্রনেতা ও বর্তমান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলমকে আনা হয়।
শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান জাফির তুহিন বলেন, আগামী কমিটিতে আমি সাধারণ সম্পাদক হতে চাই। আর দুদু ভাই হলে সভাপতি হবেন। তার সঙ্গে কেন আমি দ্বন্দ্বে যাব। এখন দল যদি আমাকে কোথাও না রাখে তাতেও আমি খুশি। একটি পক্ষ আমার সঙ্গে দুদু ভাইয়ের দ্বন্দ্বের মিথ্যা খবরটি প্রচার করছে। এসব বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেও শামসুজ্জামান দুদুর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষক দলের সভাপতি থাকা অবস্থায় বিএনপির মহাসচিব হয়েছিলেন প্রয়াত তরিকুল ইসলাম, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। বিএনপির বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কৃষক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। বিএনপিতে একটি মিথ চালু আছে যে কৃষক দলের সভাপতি, সহসভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হলে পরবর্তীতে বিএনপির মহাসচিব হওয়া যায়। এই কারণে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু কৃষক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। তিনি এর আগে ২০১৯ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসন বিষয়ক বিএনপির কমিটির আহ্বায়কও ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে কৃষক দলের আগামী কমিটিতে শামসুজ্জামান দুদুকে বাদ দিতে হলে বিএনপিতে প্রমোশন দিতে হবে। কারণ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এখন যদি তাকে কৃষক দলের কমিটি থেকেও বাদ দেওয়া হয়, আর দলের মধ্যে প্রমোশন না দেওয়া হয় তাহলে তিনিও হয়তো বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন। আর দুদু যেহেতু বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন, তাহলে তাকে প্রমোশন দিতে হলে স্থায়ী কমিটির সদস্যই করতে হবে।
প্রসঙ্গত, কৃষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ১৯৮০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন কৃষক দল। মূল দলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠন হলেও দেশের কৃষক জনগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া বা সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তেমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল না সংগঠনটির। এর মধ্যে ২০ বছর পর ২০১৯ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদুকে আহ্বায়ক আর হাসান জাফির তুহিনকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। তখন বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন করে তারা কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করবে। কিন্তু তারা ২ বছর পর ১২ মার্চ সম্মেলন করে।
এএইচআর/এনএফ