নির্বাচন, বর্জন ও বহিষ্কারে বিএনপির বছর শেষ
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পতাকা
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গত বছর বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়। মাঝখানে করোনাভাইরাসের অজুহাতে দু’টি উপনির্বাচন বর্জন করে দলটি। যদিও পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে উপনির্বাচনসহ বর্তমানে চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিয়মিত দলীয় প্রার্থী দিয়ে যাচ্ছে তারা। আর এভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ-বর্জন, দিবস ভিত্তিক কর্মসূচি পালন এবং নিয়মিত বিরতিতে দলের নেতাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দলটির গত বছরের কার্যক্রম।
করোনা মহামারির বছর ২০২০ বিশ্বের মানুষের জন্য দুঃখ-কষ্ট নিয়ে হাজির হয়েছিল। তবে বছরটা ‘কিছুটা’ ব্যতিক্রম ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে। করোনার কারণেই নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। যা এখনও বহাল আছে।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালে মারা গেছেন বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী।
প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালের ১ ফ্রেবুয়ারি দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এরপর করোনাভাইরাসের মধ্যেই ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু করোনার অজুহাতে গত ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত যশোর-৬ ও বগুড়া-১ উপনির্বাচন বর্জন করে দলটি। তবে পরবর্তীতে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ ও ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৮ এবং সিরাগঞ্জ-১ সহ প্রতিটি উপনির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। বর্তমানে কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী দিচ্ছে বিএনপি।
২০২০ সালে করোনার কারণে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম বন্ধ ছিল বিএনপির। তবে করোনার মধ্যেই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে দলটি। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি ও ভার্চুয়াল আলোচনা সভাও করেছে তারা।
২০২০ সালে প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। শুধু ডিসেম্বরের শেষ ১০ দিনে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ১০ জন জেলা পর্যায়ের নেতাকে। এছাড়া দু’জন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়েছে।
করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে খালেদা জিয়াকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়।
করোনার কারণে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম বন্ধ ছিল বিএনপির।
গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে পাবনা জেলার চাটমোহর পৌর বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জিয়াউল হক সিন্টু, মো. আনোয়ার হোসেন মাসুম এবং ১ নং সদস্য প্রফেসর আব্দুল মান্নানকে বহিষ্কার করা হয়। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. খুরশীদ আলম মতি, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবু বকর সিদ্দিক, বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক জানে আলম খোকাকেও দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। আর শোকজ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দী হন খালেদা জিয়া। এরপর দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বিএনপি আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামও করেছে। তবে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেনি। কিন্তু চলতি বছর দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গত ৩ সেপ্টেম্বর আবার তার মুক্তির মেয়াদ ৬ মাস বাড়ানো হয়। যা এখনও বহাল আছে।
যদিও বিএনপির নেতাদের দাবি, সরকার খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। কারণ তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেওয়া হচ্ছে না। খালেদা জিয়া দেশের কোনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে।
নতুন বছরে নতুন উদ্যোমে মাঠে নামতে চায় বিএনপি।
ভ্যাকসিন এলে পুরোদমে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ১১৫ সদস্যের কমিটি গঠন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের অর্ডারে লেখা আছে বেগম জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছে। প্রথমে ৬ মাস এরপর আবার ৬ মাস। সেখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে যে, তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। দেশের মধ্যে যদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তাকে কোনও হাসপাতালে যেতে হলে সরকারি হাসপাতালেই যেতে হবে। এতে বোঝা যায়, কোনও মুক্তি নয়, শুধু সাজা স্থগিত করা হয়েছে মাত্র। এটা তো গৃহবন্দীতা বটেই। কারণ, তিনি তো বাইরে যেতে পারছেন না।
২০২০ সালকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, মহামারি করোনা বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বদলে দিয়েছে। এটি শুধু বিএনপির জন্য নয়, সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বেদনাময়।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি করোনার মধ্যে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। নেতাকর্মীরা সামর্থ্য অনুযায়ী সারা দেশে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আর করোনার কারণে অন্যান্য দলের মতো আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে ভার্চুয়ালি নিয়মিত আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে আলোচনা সভা হয়েছে।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সেই কারণে ক্ষমতাসীনদের ভোট ডাকাতির পরও বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নিচ্ছে।
পুরাতন বছর যেভাবেই যাক না কেন, নতুন বছরে নতুন উদ্যোমে রাজনৈতিক মাঠে নামতে চায় মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দলটির নেতাদের আশা, দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন এলে এবং শীতের প্রকোপ কমলে করোনার ঝুঁকিও কিছুটা কমবে। তখন পুরোদমে দলে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে। ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। তা পালনে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। সব মিলিয়ে আগামী বছর পুরোটা সময় বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনাড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপনে গত ১ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১১৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটিও করেছে দলটি। এছাড়া বিষয় ভিত্তিক ও জেলা ভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি পালন শুরু করছে বিএনপি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বিএনপির নতুন বছরের লক্ষ্য। বাংলাদেশে যে একক কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে তা থেকে মানুষকে মুক্ত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা নতুন বছরের প্রধান লক্ষ্য। দেশের এই ফ্যাসিবাদী সরকার করোনার মধ্যে এক ভয়াবহ ভীতি সৃষ্টি করেছে মানুষের মনে। মানুষ কাজ হারিয়ে না খেয়ে আছে। সরকারের সেই দিকে নজর নাই। এসবের বিরুদ্ধে বিএনপি মাঠে থাকবে।
শামসুজ্জামান দুদু বলেন, বিএনপি জানুয়ারি থেকেই সাংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় ভিত্তিক কর্মসূচি পালন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে। সেজন্য আমাদের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
২০২০ সালে মারা গেছেন বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী
করোনা এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ২০২০ সালে বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী মারা গেছেন। করোনায় মারা যাওয়া বিএনপির উল্লেখ্যযোগ্য নেতারা হলেন- দলটির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান। রোগে মারা গেছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বাবু।
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপির ১০১ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন। আর বার্ধক্যজনিত রোগে সব মিলিয়ে দেড় শতাধিক নেতাকর্মী মারা গেছেন ২০২০ সালে।
এএইচআর/এইচকে