প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সংগঠনের মূলমন্ত্রের আলোকে আদর্শবান নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শান্তির পথ ধরে প্রগতির পথে আমরা এগিয়ে চলব। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষা ছাড়া একটা জাতি এগোতে পারে না সেই কথাটা মাথায় রেখে ছাত্রলীগকে চলতে হবে। আদর্শ নিয়ে না চললে কখনো বড় হতে পারবে না। দেশকে কিছু দিতে পারবে না। মানুষকে কিছু দিতে পারবে না।’ 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে সংগঠন জাতির পিতা গড়ে তুলছিলেন মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য, যে সংগঠন এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে গেছে, যে সংগঠন এ দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এগিয়ে যাওয়ায় সংগ্রামী ভূমিকা নিচ্ছে- সে সংগঠনের নামই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই ছাত্রলীগ এগিয়ে যাবে সেটাই আমার কামনা।’

তিনি বলেন, ‘নিজের ঐতিহ্য মাথায় রেখে জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তোমরা নিজেদেরকে গড়ে তুলবে।’

যেকোনো রাজনীতিবিদের জন্য আদর্শ নিয়ে চলাটাই সবচেয়ে বড় কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সততা এবং আদর্শের পাশাপাশি লক্ষ্য স্থির থাকলে পরে যেকোনো অর্জনই সম্ভব। আর এটা জাতির পিতা দেখিয়ে গিয়েছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে চলবে। সেটাই আমাদের আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা।’

ছাত্রলীগের সাবেক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করেন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। এছাড়া ছাত্রীলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাটার্য বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরে ভিডিও ডকুমেন্টারি পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ভার্চুয়াল ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আলোচনা সভাটি সরাসরি সম্প্রচার করে। এছাড়াও দেশের সকল জেলা, মহানগর ও উপজেলার দলীয় কার্যালয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতির পিতার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এবং ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এর বিভিন্ন খন্ডগুলো পড়ার আহ্বান জানান।

সে সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ডিক্লাসিফাইড রিপোর্ট শেখ রেহানার সহযোগিতায় খুঁজে বের করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সময়মতো সেগুলোও প্রকাশ করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে অবদান তা এসব রিপোর্ট থেকেই বের হয়ে আসে।’

জাতির পিতার ত্যাগ ও দেশাত্মবোধ থেকে শিক্ষা গ্রহণের পাশপাশি দেশের প্রকৃত ইতিহাস অন্বেষণের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন। দেশের বর্তমান স্বাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ উল্লেখ করে একে আরও বৃদ্ধিতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে ও স্কুল চালুর উদ্যোগ নেওয়ার সময় করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলে আসার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সংসদ টিভির মাধ্যমে টেরিস্টোরিয়াল ব্যবহার এবং অনলাইনে শ্রেণী কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উল্লেখ করেন।

করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিবারের মতো এবারও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩৪ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে ও প্রায় দুই কোটি বৃত্তি এবং উপবৃত্তির টাকা বিতরণ অব্যাহত রেখেছে বলেও সরকার প্রধান জানান। 

শেখ হাসিনা এ সময় পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এই সময়কে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘ছাত্রদেরকে আমি বলব বসে না থেকে যা পাও, নিজেরা কিছু পড়াশোনা কর। এখান একটা সুযোগ তাই পাঠ্যপুস্তক তো পড়বেই, অন্যান্য বইও পড়তে হবে। কারণ জ্ঞান যত বেশি অর্জন করতে পার ততই নিজেকে আরও সম্পদশালী মনে করবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ধন, সম্পত্তি থাকে না। কিন্তু শিক্ষা এমন একটা সম্পদ যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আর এই সম্পদ থাকলে জীবনে কোনোদিন হোঁচট খাবে না, আমাদের ছেলে-মেয়েদের সে শিক্ষাই দিয়েছি। কাজেই তোমরা সেভাবেই শিক্ষা নেবে ও ছাত্রলীগের কাজও সেটাই থাকবে, নিজেরা পড়বে এবং অন্যকেও পড়াবে।’

নিজ গ্রামের নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞান প্রদানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি তার আহ্বানের পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে গ্রামের স্কুল, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে পারলে পড়াশোনায় সহযোগিতা কর।’ 

প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলা ও করোনা সংক্রামক ব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের প্রতি তার আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন।

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দানকারী ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। বাংলা, বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়।

সংগঠনকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি সংগঠনটা শক্তিশালী না থাকে তাহলে কোনো কাজই সফলভাবে করা যায় না। কারণ মানুষের শক্তিটাই সবথেকে বড় শক্তি। এই শক্তিই মানুষকে সাহস জোগায়, যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রেরণা জোগায়।’ 

তিনি ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সে সময়কার সামরিক শাসনকে অগ্রাহ্য করে দেশে ফিরে এসে সংগঠন গড়ে তোলাতে মনোনিবেশ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগই বেশি রক্ত দিয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ভোট ও ভাতের অধিকার আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে যেকোনো আন্দোলনেই যদি আমরা দেখি, তাহলে সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে ৭৫’এ জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখলের সময়।’ 

তিনি বলেন, ‘খন্দকার মোস্তাককে আগে সে (জিয়া) মদদ দেয়। এরপর মোস্তাককে হটিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি বনে যায়। আর দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গোড়াপত্তন করে।’

এরপর জিয়ার কাজই ছিল ছাত্রলীগের নেতাদেরকে প্রলোভন দিয়ে দলে টানার চেষ্টা করে; সেটা না হলে গুম, খুন, হত্যা। এ সময় শিক্ষাঙ্গনে মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের বিপথগামী করে জিয়াউর রহমান- এমন অভিযোগও আওয়ামী লীগ সভাপতির। পক্ষান্তরে তিনি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে বই-কাগজ কলম তুলে দেন, বলেও উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর থেকে। যে কারণে বাংলাদেশ তার কাঙ্খিত উন্নতি অর্জনে ব্যর্থ হয়। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, গুম ও খুনে মেতে ওঠে সামরিক জান্তা। 

শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর বাংলাদেশ আবার উন্নতি করতে পারবে, এটা তারা মানতে চায়নি। বরং বাংলাদেশকে ব্যর্থ করতে চেয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন একেবারে নস্যাৎ হয়ে যায়- সেটাই তাদের লক্ষ্য ছিল এবং যে চক্রান্ত এখনও চলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুর অভিঘাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য মুজিববর্ষ উপলক্ষে তার সরকার গৃহীত বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। মুজিববর্ষে দেশের সকল ভূমিহীন-গৃহহীনকে ঘর করে দেয়ায় তার সরকারের চলমান কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্যও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেক গৃহহীনকে আমরা ঘর করে দেব ও মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ দিয়ে সমগ্র দেশকে আমরা আলোকিত করব।’ 

‘মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসহ মৌলিক সেবাগুলো যেন সবাই পেতে পারে ও মাথা উঁচু করে দেশের মানুষ বাঁচতে পারে সে পদক্ষেপও নেব’, যোগ করেন তিনি। 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করব। পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদনের দিকেও আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।’

যার যেখানে যে জমি রয়েছে বা পরিত্যক্ত জমিতে তিনি ফসল ফলানোর মাধ্যমে করোনার প্রাদুর্ভাবে বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিলে তা মোকাবিলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় এ সময় তিনি দেশের মানুষের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন।

ওএফ