জনমতের ভিত্তিতেই ইশতেহার তৈরির লক্ষ্যে জামায়াতের ‘মিশন সাত দিন’
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার কেবল নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ভোটার, রাষ্ট্র এবং ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনার মধ্যে একটি লিখিত সামাজিক চুক্তি। সেই চুক্তিটি ঠিকঠাক সারতে চায় জামায়াতে ইসলামী জনমতের ভিত্তিতে। যে ইশতেহার তৈরিতে জনতা হবে সহলেখক।
ইশতেহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে কী করবে, কীভাবে করবে এবং কোন অগ্রাধিকারকে সামনে আনবে— তার একটি রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরে।
বিজ্ঞাপন
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি জনবান্ধব, বাস্তবসম্মত ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ‘জনতার ইশতেহার’ নামে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ উদ্যোগের আওতায় আগামী সাত দিনব্যাপী (১৮ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশবাসীর কাছ থেকে সরাসরি মতামত সংগ্রহ করা হবে। এজন্য জামায়াতে ইসলামীর নির্ধারিত ওয়েবসাইট (www.janatarishtehar.org) ও অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নীতিগত মতামত, সমস্যা ও প্রস্তাবনা জমা দিতে পারবেন। লিখিত মতামতের পাশাপাশি অডিও ও ভিডিও মাধ্যমেও মতামত প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
‘জনতার ইশতেহার’ তৈরিতে প্রথম দিনেই দেশবাসীর অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে বলে দাবি করেছেন জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনতার ইশতেহার হলো বাংলাদেশের প্রথম জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর ইশতেহার প্রণয়ন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নাগরিকরা শুধু ভোটার নন, বরং জাতীয় নীতিনির্ধারণের সহ-লেখক। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে একটি সত্যিকারের People-Powered, Data-Driven জাতীয় ইশতেহার তৈরি করার উদ্দেশ্যে। এখানে জনগণের প্রতিটি মতামত, প্রতিটি প্রস্তাব এবং প্রতিটি অগ্রাধিকারই ইশতেহার প্রণয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নাগরিকদের মতামত, তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর টুলের সমন্বয়ে Specific, Measurable এবং Time-bound কাঠামোয় একটি অংশগ্রহণমূলক “জনতার ইশতেহার” প্রণয়নই জামায়াতের এই উদ্যোগের লক্ষ্য।
“আজ ছিল প্রথম দিন। আমর অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি সারাদিন। যা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। আমরা প্রত্যাশা করছি দেশবাসীর স্বর্তস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নিয়ে জনতার ইশতেহার তৈরিতে সহলেখকের ভূমিকায় সহযোগিতা করবেন”—এমন আহ্বান জানান তিনি।
রাজনীতিতে নাগরিকের অংশীদারিত্ব জবাবদিহিতার নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য জামায়াতের
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ইশতেহার প্রণয়ন প্রক্রিয়া মূলত বুদ্ধিজীবী ও দলীয় নীতিনির্ধারকদের সীমিত আলোচনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। সেখানে সাধারণ জনগণের মতামত ও প্রত্যাশা সেখানে খুব কমই প্রতিফলিত হয়। এই কারণে ইশতেহার অনেক সময় জনগণের বাস্তব জীবন, স্থানীয় চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংযোগ হারায়। জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছাড়া সে ইশতেহার সাধারণ নীতিপত্র মাত্র। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে আসতে চাই।
তিনি বলেন, যা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তা কার্যকর ফল দিতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী এই সীমাবদ্ধতার মূল জায়গায় পরিবর্তন আনতে চায়। এজন্য একটি ইশতেহার প্রণয়ন মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে জনগণের সরাসরি মতামত, স্থানীয় সমস্যা এবং অগ্রাধিকার তথ্যভিত্তিকভাবে প্রতিফলিত হবে।
তিনি বলেন, মেজারেবল কাঠামোর ভিত্তিতে প্রতিশ্রুতি নির্ধারণের মাধ্যমে ইশতেহার কেবল একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় রূপ নেবে। প্রমিজ ট্রাকার (Promise Tracker) প্রবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে, যেখানে নাগরিকরা সহজেই দেখতে পারবেন কোন অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়েছে, কোনটি চলমান, আর কোনটির অগ্রগতি থেমে আছে বা মন্থর।
ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতির মতে, এটি শুধু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে না; বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নাগরিক আস্থা, অংশীদারিত্ব এবং নীতি-নির্ভর রাজনীতির একটি নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করবে।
ইশতেহার বিশ্লেষণ করবে ভোটাররাই
বাংলাদেশের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্রে ইশতেহার ভোটারদের তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি দমন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি কিংবা বৈদেশিক নীতি—এসব বিষয়ে কোন দল কী বলছে, তা ইশতেহারেই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উঠে আসে। নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি অনুযায়ী, ইশতেহারে অবাস্তব ও অসাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার নির্দেশনাও রয়েছে (আরপিও, ১৯৭২ সংশোধিত)।
ইশতেহারের গুরুত্ব কেন
সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ১১)। এখানে জনগণ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। কিন্তু ভোট দেওয়ার আগে ভোটারের জানার অধিকার রয়েছে যে দল বা প্রার্থী রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে কী ধরনের নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এই জানার অধিকার পূরণ করে ইশতেহার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যে উদ্যোগটা নিয়েছেন নিঃসন্দেহে অভিনব ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইশতেহার হচ্ছে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট। নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের মতামতরে ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। অতীতে কোনো দল জনগণের জনমতের ভিত্তিতে ইশতেহার তৈরি করেনি। আমি এটিকে নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবে দেখছি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বলেছিল দশ টাকায় চাল খাওয়াবে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই রক্ষা করেনি। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার পর সব ভুলে গেছে। আসলে বাংলাদেশে সরকারে যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা কাউন্টেবল করতে পারি না। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর এই ইশতেহার তৈরির প্রক্রিয়া সাধুবাদের যোগ্য।
জামায়াতের ইশতেহারে তিন বিষয় পরিষ্কার চান দিলারা চৌধুরী
জামায়াতকে ইশতেহার তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়ে এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “আমার পর্যবেক্ষণ— জামায়াতের রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা যুগান্তকারী। তবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ইশতেহার তৈরির ক্ষেত্রে জামায়াতকে তিনটি বিষয় পরিস্কার করতে হবে। ১. শরীয়া আইন, ২. নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন, ৩. উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন। এই তিন বিষয় যদি পরিষ্কার করতে পারে তাহলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে জামায়াত জনমত আরও বাড়বে। কারণ ইশতেহার হচ্ছে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট। আবার ভোট টানার ব্যাপারও।
জনমতের ভিত্তিতে ইশতেহার প্রণয়ন-ভালো উদ্যোগ
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির পর্যবেক্ষণ করা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব ঢাকা পোস্টকে বলেন, কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত, পরিমাপযোগ্য ও সময়নির্ধারিত ইশতেহার— যা কাগজে নয়, বাস্তব নীতিতে প্রতিফলিত হবে। জামায়াত দীর্ঘদিন জনগণের সঙ্গে মিশতে পারেনি। এখন মিশছে। ইশতেহার তৈরিতে জনগণের মন্তব্য, মতামত জানতে চাওয়া, সেটার ভিত্তিতে ইশতেহার প্রণয়ন ভাল উদ্যোগ।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইশতেহার অপরিহার্য। এটি ভোটারকে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে, রাজনৈতিক দলকে নৈতিকভাবে বাধ্য করে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ভিত্তি গড়ে তোলে। জামায়াত প্রতিশ্রুতিশীল থাকলে জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই ইশতেহার তৈরি করবে।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর নির্ধারিত ওয়েবসাইট (www.janatarishtehar.org) ও অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নীতিগত মতামত, সমস্যা ও প্রস্তাবনা জমা দিতে পারবেন। লিখিত মতামতের পাশাপাশি অডিও ও ভিডিও মাধ্যমেও মতামত প্রদানের সুযোগ থাকবে।
এব্যাপারে জামায়াত সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইশতেহার প্রণয়নে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। ‘জনতার ইশতেহার’ কর্মসূচির মাধ্যমে সেই ধারা পরিবর্তন করে জনগণকে শুধু ভোটার নয়, বরং ইশতেহারের সহলেখক হিসেবে যুক্ত করাই এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।”
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
‘জনতার ইশতেহার’ কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও মতামত দেওয়ার সুযোগ এই ওয়েবসাইটটিতে পাওয়া যাবে: (www.janatarishtehar.org)।
তিন মৌলিক স্তম্ভে মতামত নেবে জামায়াত, থাকবে প্রমিজ ট্র্যাকার
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে প্রথমত জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ : যেখানে নাগরিকরা অনলাইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করবেন।
দ্বিতীয়ত, অনলাইন ইশতেহার প্রযুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ, যার মাধ্যমে সংগৃহীত মতামতগুলো শ্রেণিবিন্যাস, মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে অনলাইনে ইশতেহার প্রকাশ করা হবে।
তৃতীয়ত, ডিজিটাল প্রমিজ ট্র্যাকার : যেখানে ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি ভবিষ্যতে জনসম্মুখে উপস্থাপনের ব্যবস্থা থাকবে। এর আওতায় একটি দ্বি-স্তরীয় ইশতেহার কাঠামো গড়ে তোলা হবে- একটি জাতীয় সমন্বিত ইশতেহার এবং অন্যটি সংসদীয় আসনভিত্তিক বা স্থানীয় ইশতেহার।
সংগৃহীত সব মতামত কাঠামোবদ্ধ ও তথ্যভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে একটি Measurable, Specific ও Time-bound কাঠামোর ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন হবে।
এছাড়া ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য ভবিষ্যতে একটি ওয়েবভিত্তিক ডিজিটাল প্রমিজ ট্র্যাকার চালুর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে দলটি।রয়েছে বলে তিনি জানান।
জেইউ/এসএম