বাংলাদেশি নাগরিকদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রয়েছে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি। তবু দেশে ও বিদেশে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল চক্র ও মধ্যস্বত্বভোগী। 

আইন অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই বৈদেশিক কর্মসংস্থান হতে হবে। তবে উচ্চতর পেশার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই ভিসা সংগ্রহ করেন। তবে বিদেশ যেতে নিয়ম-কানুন পরিপালনের বিষয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা রয়েছে। এতে দালালের নিকট যেতে হয় একজন অভিবাসন প্রত্যাশীকে।

কোন দেশে কোন কাজের বেতন ও সুযোগ সুবিধা কেমন, নিজ দেশে পাসপোর্ট, মেডিকেল, ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স, ভিসা নেওয়া, বিমান টিকিট, বিমানবন্দরে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক গাইডলাইন চান বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা। এই সেবার স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

• বিদেশ যেতে নিয়ম-কানুন পরিপালনের বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে
• দালাল খুঁজতে গিয়ে পাচারকারীর শিকার
• মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলার প্রক্রিয়া শুরু

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ সেবার ঘাটতি রয়েছে। এতেই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী বা পাচারকারীর আবির্ভাব হয়েছে। দালাল খুঁজতে গিয়ে অনেকেই পাচারকারীদের শিকার হন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একজন প্রবাসী যা আয় করেন তার প্রায় সবই চলে যায় ধারদেনা শোধ করতে। এছাড়া পরিবারের লোকজনের ভরণপোষণে ব্যয় হয়। দিন শেষে প্রবাসীদের সঞ্চয় থাকে না। তাই অভিবাসন ব্যয় যৌক্তিক করার দাবি শুধু আন্তর্জাতিক সংস্থা, দেশীয় এনজিও বা অভিবাসীর নয়; এটি সরকারের অন্যতম এজেন্ডাও বটে। 

অভিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করছেন সাংবাদিক মিরাজ হোসেন গাজী। তিনি বলেন, একজন অভিবাসীর উপার্জন করা অর্থ গঠনমূলভাবে বিনিয়োগ করা হয় না। অধিকাংশ প্রবাসী বিদেশে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত বেতন ও কাজের পরিবেশ পান না। অনেকেই কর্মস্থল থেকে পালাতে বাধ্য হন। অনেকে জেল-জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরেন। এসব ঘটে বিদেশে যাওয়ার আগে সঠিক তথ্য ও বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে রিসিভিং কান্ট্রি অর্থাৎ যে দেশ চাকরি দেয় সে দেশের নিয়ম কানুন এবং চাহিদা অন্যতম বিষয়। বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার ও এমপ্লয়মেন্ট  অ্যান্ড ট্রেনিং বিদেশে চাকরির সুযোগ সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য দেয়। সরকার এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করে। যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি লোক প্রেরণ করে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নিয়োগকারী দেশের শ্রম বাজারের হালহকিকত সবচেয়ে ভালো জানে। কারণ তাদের সে বাজারের সাথেই প্রতিযোগিতা করতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভিসা ট্রেডিং হয়। নিয়োগকারীর তথা ভিসা স্পন্সর প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে ভিসা ক্রয় না করলে বাংলাদেশ থেকে সে ভিসায় কাউকে প্রেরণ করা যায় না। এই ট্রেডিং পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অভিবাসন প্রত্যাশীর জন্য ভিসা যোগাড় করে।

এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে ২০০৬/০৭ সালের দিকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (আউটসোর্স) নামে চাহিদার অতিরিক্ত লোক অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশটিতে দেওয়া হয় বাংলাদেশ থেকে। এতে অমানবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগ বন্ধ করে।

মালয়েশিয়া ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে লেবার সোর্স কান্ট্রির স্বীকৃতি দেয়। জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে সরাসরি মালয়েশিয়া নিয়োগ দেয় শুধু প্লান্টেশন সেক্টরে। পরবর্তীতে জিটুজি প্লাস অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রান্তে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুযোগ দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া ১০টি এজেন্সিকে নির্ধারণ করে ১৩শ এজেন্সির মধ্য থেকে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, পাওয়ার অ্যাটর্নি এবং ডিমান্ড লেটার ১০টি এজেন্সির নামে হলেও ৩০৮টি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় লোক প্রেরণ করেছে। কারণ মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের প্রকৃতি অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সি অনেক আগেই নিয়োগকারী বা প্রতিনিধির নিকট থেকে আর্থিক মূল্য দিয়ে ভিসা সংগ্রহ করেছিল। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও ডিমান্ড লেটার ১০টি এজেন্সি পেয়েছে। বাকি এজেন্সি এই ১০টির মাধ্যমেই লোক প্রেরণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত ছিল বিদ্যমান শ্রম মার্কেটের প্রকৃতির বিপরীত।

ফলে খরচ বেড়েছে এবং একই লাইসেন্সধারী হওয়ার পরেও এজেন্সিগুলো অবমূল্যায়িত হয়েছে বলে মনে করে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এর পুনরাবৃত্তি চায় না। উল্লেখ্য, এই প্রক্রিয়াকে মনোপলি হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের হাইকোর্টে রিট হয় এবং মাহাথির সরকার লোক নিয়োগ বন্ধ করে।

বর্তমানে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বন্ধ শ্রমবাজার খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট বিরোধী আন্দোলন করছে। আলাপ করে জানা গেছে, এজেন্সিরা দুর্নীতিমুক্তভাবে যৌক্তিক খরচে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে চায়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেছেন, ক্ষতিকর হবে এমন ধরনের সিন্ডিকেট করবেন না এবং মালয়েশিয়ার চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন।

লোক নিয়োগের বেশ কিছু পরিবর্তন
মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। যেমন বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে অটো সিলেক্ট করা এবং ডিমান্ড লেটার ও পাওয়ার অব এটর্নি দেওয়া। ফলে আগে থেকেই এজেন্সিগুলোর ভিসা সংগ্রহ করার প্রয়োজন হবে না। এতে অভিবাসন খরচ কমে যাবে বলে এজেন্সিগুলো দাবি করেছে।

এ কারণে সব এজেন্সি লোক পাঠানোর জন্য আন্দোলন করছে। আইনত কোনো অপরাধ ছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সিকে লোক পাঠানো থেকে বিরত রাখার সুযোগ নাই। তবে অবশ্যই মালয়েশিয়া সরকারের নিয়ম-কানুনের মধ্যে হতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে মালয়েশিয়া নিশ্চয়তা চায় যে, রিক্রুটিং এজেন্সি উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে উল্লেখিত দায় দায়িত্ব পালন করবে। তবে নির্দিষ্ট সংখ্যক এজেন্সির মাধ্যমে লোক নিয়োগের ফলে ভালো দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে কাজ না পাওয়া বা প্রতারিত হওয়ার নজির নাই। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা এজেন্সিগুলোরই সুনাম বয়ে আনে।

বাংলাদেশ সরকার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর পারফরমেন্স মূল্যায়ন করে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করার বিধি করেছে। ফলে মালয়েশিয়া বা অন্যান্য দেশ সহজেই রিক্রুটিং এজেন্সি পছন্দ করে নিতে পারবে বা অভিবাসন প্রত্যাশীরা চিনে নিতে পারবে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ডাটা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফলে নিয়োগকারীরা কর্মী বাছাই করে নিতে পারবে। জানা গেছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অভিবাসন খরচ শোধ করার উপায় চালুর জন্য বায়রা থেকে সরকারের নিকট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বায়রা বীমা চালু করেছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এ ধরনের উদ্যোগ অভিবাসীদের কল্যাণ বয়ে আনবে।

এইচকে