কোরিয়ার প্রাচীন ইতিহাস জুড়েই রয়েছে হাজার বছরের বৌদ্ধ ঐতিহ্য। লাখ লাখ দৃষ্টিনন্দন অপরূপ সুন্দর বৌদ্ধমূর্তি ও ঐতিহাসিক টেম্পলের দেশ খ্যাত দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। এরমধ্যে ৬০০-১০০০ বছর আগের দৃষ্টিনন্দন ইতিহাস সমৃদ্ধ বৌদ্ধ বিহার রয়েছে এক হাজারেরও বেশি। এগুলোর মধ্যে জংদোংসা, বোমোনসা, জাজেআম, হে ইনসা, জোগেসাসহ জুং হাকসা অন্যতম। সাধারণত কোরিয়ান টেম্পলের নামের পাশে আঁম ও সাঁ এ দুটি শব্দ যুক্ত থাকে।

আর সেই ঐতিহাসিক ও সেরা সৌন্দর্য শালী  জুং হাকসা বৌদ্ধ বিহারে অনুষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মিলনমেলা সংঘদান ও অষ্ঠপরিষ্কার দানানুষ্ঠান। জগতের সব প্রাণী ও প্রকৃতির মঙ্গল সুখ কামনায় ও করোনা মহামারির কবল থেকে পুরো পৃথিবীবাসী মুক্ত হওয়ার মানসে সরকার ঘোষিত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশটির উইজংবু শহরের বোসান এলাকার ঐতিহাসিক জুং হাকসা বৌদ্ধ বিহারে উদযাপন করা হয়েছে এ মিলন মেলা তথা সংঘদান, অষ্ঠপরিষ্কার দান ও মতবিনিময় সভা। গত শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় এ দানসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কোরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রবাসীরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সাত সকালে অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে উপস্থিত হন কোরিয়ান এ বৌদ্ধ বিহারে। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ছিল পরম করুণাময় তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের পূজা, সংঘদান, অষ্ঠপরিষ্কার দান, পঞ্চশীল গ্রহণ, বিকেলে আলোচনা সভা, গৌতম বুদ্ধের অহিংস ধর্ম নিয়ে আলোচনা সভা, প্রদীপ ও পানীয় পূজা এবং সমবেত প্রার্থনা। পূজার বেদীতে সাজানো নানা প্রকার খাদ্য ভোজ্যাদি, থরে থরে সাজানো হাজারো বুদ্ধের মূর্তি ও রঙ বেরঙের প্রদীপ পূজা দেখে আগত পূর্ণার্থীদের মনে পূণ্য সঞ্চারিত হয়। এ সময় বুদ্ধের শরীর থেকে কিছুক্ষণ পর পর আলোক উজ্জ্বল স্বর্ণালী আভা চারিদিকে বিচ্ছুরিত হয়ে এক স্বর্গীয় দ্যুতি সৃষ্টি করছিল।

এ সংঘদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কোরিয়ান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও জুং হাকসা বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ভেন মিয়োগোয়াং ভিক্ষু। এছাড়াও ধর্মদেশক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন থাইল্যান্ড থেকে আসা বৌদ্ধ ভিক্ষু নামজু সুনিম ও বেগচান সুনিম এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তিষ্য সুনিম। 

তারা বলেন, সংঘদানে চার-পাঁচ জন ভিক্ষুকে দান করলেও সংঘ বলতে অতীত, অনাগত ও বর্তমান সমস্ত সংঘের (বৌদ্ধ সন্ন্যাসী) উদ্দেশ্যে দান করা হয়। তারা আরও বলেন, বৌদ্ধ দর্শনে দান হলো প্রশংসিত একটি কর্ম। সবাই জীবনে কম বেশি দান করে থাকে। দান শব্দের সঙ্গে মালিকানা স্বত্ব ত্যাগের বিষয়টি জড়িত। আর এতে মানুষের লোভ চিত্ত ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়।

এরপর উত্তম চরিত্র গঠনের মানসে ভিক্ষু সংঘকে পঞ্চশীল দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বৌদ্ধ কমিউনিটি নেতা শ্যামল বড়ুয়া। জোগেজাং কোরিয়া-বাংলাদেশ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সংঘানন্দ ভান্তে উপস্থিত সবাইকে পঞ্চশীল তুলে দেন। প্রাণী হত্যা না করা, বিনা অনুমতিতে অপরের জিনিস না ধরা, মিথ্যা কথা না বলা, নিজ স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত কাম সেবন না করা ও মদ গাঁজাসহ সব নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন না করা এ পাঁচটি শীল বা পঞ্চনীতি গ্রহণ করে মুহূর্তের মধ্যে সবাই এক সুন্দর চেতনায় ঋদ্ধ হন।

করোনাকালে প্রবাসে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এত লোক মিলিত হয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি জানান দেয়। তাই তো আয়োজক কমিটির বিপ্লব বড়ুয়া, তপু বড়ুয়া, নিকাশ বড়ুয়া, রাহুল বড়ুয়া, প্রশান্ত বড়ুয়া, কিশোর বড়ুয়া ও জিশু বড়ুয়াসহ অনেক প্রবাসী বৌদ্ধরা দেশ-বিদেশের সবাইকে সংঘদানের পূণ্যদান ও শুভেচ্ছা জানান। 

দেগু, গিম্পু ও অন্যান্য এলাকা থেকে আসা চৌধুরী বিজন বড়ুয়া ও অপু বড়ুয়া, বিকাশ বড়ুয়া ও কেনিয়ন বড়ুয়া বলেন, আয়োজনকারীদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। থাইল্যান্ড থেকে আসা নারী উপাসিকা জনি মঙ্গল বলেন, আমি প্রথমবার বাংলাদেশিদের সঙ্গে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আসতে পেরেছি। আমি অনেক আনন্দিত। 

সংঘদান অনুষ্ঠান শেষে সবাই মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। অনেকদিন পর প্রবাসে এত লোকের সাক্ষাৎ ও বাংলায় মনের ভাব প্রকাশসহ বাংলা খাবারের স্বাদ পেয়ে সবাই যারপরনাই আনন্দিত ছিল।

ভদন্ত সংঘানন্দ ভিক্ষুর সঞ্চালনায় বিকেলে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ-কোরিয়া বৌদ্ধ বিহারের সভাপতি বিধান বড়ুয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী সাংবাদিক অসীম বিকাশ বড়ুয়া, সংস্কৃতি কর্মী সুমি বড়ুয়া ও ইমন বড়ুয়া।

আগামী বছর আরও বড় পরিসরে সংঘদান তথা এ ধরনের মিলনমেলা আয়োজন করার ইচ্ছে আছে বলে জানান আয়োজক কমিটির নিপুল বড়ুয়া, অনুতোষ বড়ুয়া, শ্বনব বড়ুয়া, রোনাল বড়ুয়া, টিপস বড়ুয়া, উত্তম বড়ুয়া, হৈমন্তী বড়ুয়া, প্রমা বড়ুয়া, সুপর্না বড়ুয়া ও সেতু বড়ুয়া। 

এসএসএইচ