মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের পাসপোর্টের ডিজিটাল সেবার মারপ্যাঁচে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন প্রবাসীরা। এই মারপ্যাঁচের কারণে অনেক প্রবাসী বৈধতা হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। অন্যদিকে পাসপোর্ট জটিলতায় মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচিতেও অংশ নিতে পারছেন না শত শত বাংলাদেশি। দূতাবাসের ডিজিটাল পাসপোর্ট সেবা যেন সোনার হরিণ পাওয়ার রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।

গত বছরের মার্চ থেকে মালয়েশিয়া সরকার বিভিন্ন মেয়াদে মহামারি উত্তরণে চলছে বিধিনিষেধ। আর এ বিধিনিষেধের কারণে লোক সমাগমের ওপরও জারি করা হয় কঠোর আইন। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কথা চিন্তা করে দূতাবাস সশরীরে এসে পাসপোর্ট রিনিউ না করতে এবং একই সঙ্গে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট জমা দিতে নোটিশ জারি করে। নোটিশে বলা হয়, রি-ইস্যু ফরম জমা দেওয়ার সময় অবশ্যই ব্যক্তিগত হোয়্যাটসঅ্যাপ নম্বর দিতে হবে। যাতে পাসপোর্ট জমা শেষে নিজ নিজ মোবাইলে মেসেজ দেওয়া হবে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট জমা দেওয়া কার্যক্রম শুরু হলেও একটি অনিশ্চয়তায় পড়েন বাংলাদেশিরা। এক থেকে তিন মাস বা তার অধিক সময় চলে গেলেও ব্যক্তিগত মোবাইলে মেসেজ তো দূরের কথা অনলাইনে নামও পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে মালয়েশিয়ায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দূতাবাসে এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। দূতাবাসেও বাড়তে থাকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। সব বিষয় বিবেচনা করে প্রাথমিক অবস্থায় মোবাইল কলের মাধ্যমে পরবর্তীতে অনলাইনের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রবাসীরাই অনলাইন সেবা বুঝতে না পারায় পাসপোর্ট দূতাবাসে এসেছে কি না বা কীভাবে আবেদন করতে হয় এসব বিষয়ে জটিলতার মধ্যে পড়ে যান। অন্যদিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সরাসরি দূতাবাসে এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা। চালু করা হয় পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট বিতরণ।

অনলাইনের মাধ্যমে সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেদন সম্পন্ন করার পর পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ নামক পাসপোর্ট। আর অনলাইন প্রক্রিয়াতে রয়েছে বেশকিছু ধাপ, যা পূরণে সাধারণ প্রবাসীদের ব্যাপক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। দূতাবাসে পাসপোর্ট এসে মাসের পর মাস পড়ে থাকলেও অনলাইনে পাসপোর্ট ডেলিভারি নম্বর না পাওয়ায় সময় মতো পাসপোর্ট পাচ্ছেন না অধিকাংশ বাংলাদেশি।

দূতাবাসের কড়া নিরাপত্তায় ভেতরে প্রবেশের সুযোগ হলেও কাউন্টারে থাকা কর্মকর্তাদের আচরণ রহস্যজনক বলে অনেকে এ প্রতিবেদককে জানান। নিজেদের সমস্যার সমাধান না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরছেন অনেকেই। কেউ বা বাধ্য হচ্ছেন দালাল ধরতে। আবার কেউ অভিযোগ করছেন টাকার বিনিময়ে দূতাবাসে না গিয়েও মিলছে পাসপোর্টসহ সব সেবা।

এমন পরিস্থিতে মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশিরা মনে করেন স্বল্প ও অদক্ষ লোক দিয়ে কাজ করালে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। তাই প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে দূতাবাসের উচিত অতিরিক্ত দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান করা। 

কোথায় যাবেন প্রবাসী বেলাল

প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক বেলাল। পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন, পাসপোর্ট তৈরিও হয়। কিন্তু সেই পাসপোর্ট এখনও হাতে পাননি। হতাশ বেলাল এখন উপায় খুঁজছেন। এখন কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন? ভেবে পাচ্ছেন না এ প্রবাসী বাংলাদেশি।

অবাক করার মতো ঘটনা ঘটেছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে। পাসপোর্ট সমস্যার সমাধানে হাইকমিশনের কর্তাদের টেবিলে টেবিলে ধর্না দিয়েও কোনো সুরাহা পাননি ভুক্তভোগী বেলাল। বারবার যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন হাইকমিশনের কর্তারা। তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় চরম সংকটে রয়েছেন এ প্রবাসী বাংলাদেশি। পাসপোর্ট না থাকায় তিনি ওয়ার্ক পারমিটও নবায়ন করতে পারেননি। আর ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে না পারায় তার নাম উঠেছে অবৈধ প্রবাসীর খাতায়। এরই মধ্যে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে মালয়েশিয়া পুলিশ তাকে আটকও করেছে। একরাত থাকার পর ১২০০ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা) ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে নেন তার চাকরিদাতা। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবেন? আবার বেশি দিন অবৈধ থেকে গেলে নতুন করে নবায়ন করতে জটিলতায় পড়তে হবে তাকে। এসব জটিলতার কথা পাসপোর্ট উইংয়ের সবারই জানা। তবুও এ প্রবাসীর পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। বরং তাকে শ্রমিকদের কল্যাণে নিয়োজিত সেই কর্মকর্তারাই হাইকমিশন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।

ভুক্তভোগী বেলাল এ প্রতিবেদককে জানান, গত ২৯ ডিসেম্বর পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন জমা দেন (এনরোলমেন্ট নম্বর MYS200000511983)। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার জন্য তাকে সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হয় চলতি বছরের ২৫ মার্চ। এরই মধ্যে করোনা সংক্রমণ রোধে মালয়েশিয়া সরকার চলাচলে জারি করে বিধিনিষেধ। বিধিনিষেধে দূতাবাস অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের মাধ্যমে পোস্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে নোটিশ জারি করে। অনলাইনে আবেদন করতে গেলে তার  এনরোলমেন্ট নাম্বারে আসে মোহাসিন মিয়া নামে আরেকজনের তথ্য। কোনো উপায় না পেয়ে বেলাল তার নিয়োগকর্তাকে বিষয়টি অভিহিত করেন। নিয়োগকর্তা তার প্রতিষ্ঠানের পেডে বেলালের পাসপোর্ট পেতে হাইকমিশনে লিখিত আবেদন করেন। আবেদন করেও পাসপোর্ট এখনও মেলেনি। সরাসরি কাইকমিশনে গিয়ে বিষয়টি অভিহিত করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

অনেকটা অপমান করে তাকে তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ওই প্রবাসী। তিনি বলেন, চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছি। অনেক টাকা গচ্চা গেছে কিন্তু পাসপোর্ট পাইনি। আবার অবৈধ হয়ে গেছি। এখন পুলিশের হাতে পড়লে আর রক্ষা নাই, জেলে পচতে হবে। তারপর দেশে ফেরত। রঙিন স্বপ্ন ধূসর হয়ে গেছে।

‘হাইকমিশনের লোকজন প্রবাসীদের মানুষই মনে করেন না। আমাদের তারা গরু-ছাগল মনে করেন। সেভাবেই আচরণ করেন,’ যোগ করেন চিন্তামগ্ন এই বাংলাদেশি।

প্রবাসী বেলালের অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাসপোর্ট বিভাগের দায়িত্বে থাকা দূতালয় প্রধান রুহুল আমিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এসএসএইচ