করোনার কারণে কেবল জরুরি পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন ছাড়া বলতে গেলে প্রায় সব সেক্টর বন্ধ ছিল। ফলে অর্থনৈতিক গতি মারাত্মকভাবে শ্লথ হয়ে যায়। সে সময় বিশ্ব ব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, মালয়েশিয়ার শক্ত ভিত্তি থাকায় অর্থনীতি দ্রুত গতি পাবে। সেটাই এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ান এএম ব্যাংক তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে, করোনা থেকে মালয়েশিয়ার অর্থনীতির দ্রুত উত্তরণের কারণ হলো সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ পণ্যের চাহিদার রিকভারি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নতি। গত অক্টোবরে মালয়েশিয়ান পারচেজিং ইনডেক্স চার মাস পরে ৪৮.১ পয়েন্ট থেকে ৫২.২ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। 

উৎপাদনের এই ইতিবাচক উত্তরণের পেছনে অন্যতম কারণ হলো করোনার কঠিন ও কঠোর শর্তগুলো ক্রমশ শিথিল করা। বিশেষ করে টিকা দেওয়ার ফলে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে দেশটি ন্যাশনাল রিকভারি প্ল্যানের চতুর্থ ধাপে আসতে পেরেছে এবং উৎপাদনে গতি ফিরেছে। এ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্পন্ন করেছে মালয়েশিয়া, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে।

মালয়েশিয়ার কেনানগা রিসার্চ উৎপাদন খাতের গতি ফেরায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলছে, দ্রুত করোনার টিকা দেওয়া, সরকারের অর্থনৈতিক সাপোর্ট ও শক্তিশালী বৈদেশিক চাহিদা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালেই ৯.১ শতাংশ হবে যা ২০২০ সালে ছিল ২.৬ শতাংশ। পাশাপাশি কেনানগা রিসার্চ মালয়েশিয়ার জিডিপি পূর্বাভাস দিয়েছে বলছে, ২০২১ সালে ৩.৫- ৪.০ শতাংশ হবে এবং ২০২২ সালে ৫.৫ - ৬.০ শতাংশ হবে।

মালয়েশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স (এমআইডিএফ) এ সময় উৎপাদন বৃদ্ধির পজিটিভ দিকের পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ এবং পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে ও ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার দিকেও ইঙ্গিত করেছে। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয়ের দিকে নজর দিয়েছে। উৎপাদনের সঙ্গে জনশক্তি জড়িত রয়েছে।

মালয়েশিয়ার বৃহত্তম উৎপাদন খাতে (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) উপযুক্ত কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে। অনেক আগে থেকেই প্ল্যান্টেশন সেক্টর কর্মী সংকটে উৎপাদন ব্যহত হওয়ার তথ্য তুলে ধরেছে। ফলে মালয়েশিয়া সরকার প্ল্যান্টেশন সেক্টরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ৩২ হাজার বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। 

ইন্দোনেশিয়া থেকে কর্মী নিয়োগ শুরু করে অন্যান্য লেবার সোর্স দেশ থেকেও কর্মী নিয়োগ করবে বলে জানা গেছে। একইভাবে কনস্ট্রাকশন, সার্ভিস, অ্যাগ্রিকালচারসহ অন্যান্য সেক্টরে বিদেশি কর্মী নিয়োগের সুযোগ প্রসারিত হতে থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ২০১৫ সাল থেকে রিহায়ারিং, ব্যাক ফর গুড ও রিকালিব্রেশন কর্মসূচির আওতায় অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়া ত্যাগ করায় কর্মী কমে গেছে। 

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজা জয়নুদ্দীন বলেছেন, সেক্টর অনুযায়ী বিদেশি কর্মীর চাহিদা নিরূপণে স্টাডি করা হয়েছে। স্পেশ্যাল কমিটি অন প্যান্ডেমিক ম্যানেজমেন্ট ২২ অক্টোবরের সভায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর প্রতিপালন সাপেক্ষে সব সেক্টরে বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমতি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্ল্যান্টেশন হবে প্রথম সেক্টর।

ইন্দোনেশিয়া থেকে কর্মী নেওয়া হবে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে কেন শুরু হলো না এমন প্রশ্ন রয়েছে। জি টু জি প্রক্রিয়ায় শুধু প্ল্যান্টেশন সেক্টরে ২০-৩০ হাজার টাকায় কর্মী নিয়োগের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এবারও কর্মী নিয়োগের সুযোগ আছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

অবধারিতভাবেই মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ চলে আসে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় স্বীকৃত সর্বকনিষ্ঠ লেবার সোর্স কান্ট্রি। এছাড়া আরও ১৪টি দেশ রয়েছে লেবার সোর্স কান্ট্রি হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগ শুরু এবং নানা অনিয়মের কারণে হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার পুরোনো নজির আছে। এতে শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

সম্প্রতি জি টু জি প্লাসের সময় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে কর্মীর নিকট থেকে অতিরিক্ত মাইগ্রেশন ফি আদায় করার অভিযোগ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের সরকার। পরে বিদেশি পণ্য গ্রহণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্মীর অতিরিক্ত অর্থ খরচের কারণে ঋণে আবদ্ধ হওয়া, শ্রম আইনের বাইরের অমানবিক শর্তাদি মানতে বাধ্য হওয়া, ঋণ শোধের জন্য বেশি আয়ের লক্ষ্যে অবৈধ হওয়া, জোর ও দাসত্বের শ্রম ইত্যাদি মানবপাচার ও জোর জবরদস্তি শ্রম হিসেবে চিহ্নিত করে পণ্য নেওয়া বন্ধ করে। ফলে প্রথম সারির উৎপাদকেরা কর্মীদের সেই অতিরিক্ত খরচের অর্থ ফেরত দিয়েছে যা নিয়োগ কর্তাদের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে।

প্রথমত মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে। পরে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি বন্ধ করে। এই দুটি ঘটনা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে কর্মী প্রেরণের পদ্ধতির সংস্কার এবং শক্ত মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া প্রত্যাশা করেন। 

তারা আরও প্রশ্ন তোলেন, প্ল্যান্টেশন সেক্টরে বাংলাদেশি কর্মীদের কাজের সুনাম থাকা সত্ত্বেও জি টু জি প্লাসের বাজে ঘটনার কারণে এখন প্রয়োজন সত্ত্বেও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী দিতে পারছে না।

এদিকে জি টু জি প্লাসের পরবর্তী চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে করোনাকালেও সর্বশেষ অনলাইন বৈঠকটি অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার নানা কথা শোনা গেছে। আশা করা যাচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে।

ওএফ