বিভিন্ন দেশে অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অভিবাসন (ইমিগ্রেশন) নীতি গড়ে উঠলেও যুক্তরাষ্ট্রে বরাবরই রাজনীতি অভিবাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির এ দেশটিতে সুষম অভিবাসন প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই মার্কিন বিশেষজ্ঞ এই মতামত দিয়েছেন। তারা আশা প্রকাশ করেন যে, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রস্তাবিত সংস্কার উদ্যোগ আমেরিকার অভিবাসনকে খানিকটা হলেও সহজ করবে।

কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভ’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আলোচকরা এই মতামত দেন। 

আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও মার্কিন ইমিগ্রেশন বিষয়ক গবেষক ড. মেহনাজ মোমেন এবং নিউইয়র্কের ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি মৌমিতা রহমান। কানাডার টরন্টোর স্থানীয় সময় বুধবার (২৭ জানুয়ারি) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি এই আলোচনা সম্প্রচারিত হয়।

ড. মেহনাজ মোমেন তার আলোচনায় বলেন, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের অংশ হিসেবে অভিবাসন নীতিমালাকে সাজানো হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিমালা সেরকম না। এখানে অভিবাসনকে রাজনীতির একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, গত এক বা দুই দশকে আমেরিকার অভিবাসন একটি সাংস্কৃতিক ইস্যু উঠেছে। অভিবাসীদের পছন্দ করা বা না করাকে কেন্দ্র করে নতুন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সংস্কার প্রস্তাবকে অভিবাসনের বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, পরিপূর্ণভাবে এই প্রস্তাবনাকে আইনে পরিণত করতে দুই কক্ষেই এটি পাস হতে হবে। সেক্ষেত্রে সিনেটে রিপাবলিকানদের বাধার মুখে পরার সম্ভাবনা আছে। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আলাদা আলাদা পদক্ষেপ হিসেবে তার পরিকল্পনা কার্যকর করতে চান। সেটি করতে হয়তো বা তাকে বেগ পেতে হবে না।

তিনি বলেন, বাইডেন তার অভিবাসন সংস্কার প্রস্তাবনায় ‘আনডকুমেন্টেড’ শব্দের বদলে ‘নন সিটিজেন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটি কিন্তু তার নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ একটি ইঙ্গিত। অভিবাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনের জন্য এই বার্তাটি অনেক প্রশাসনিক ইন্টারপ্রেটেশনকে বদলে দেবে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা তাদের পছন্দের বা অপছন্দের দেশের লোকদের আসার পথ সহজ বা কঠিন করার লক্ষ্য নিয়ে অভিবাসন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বা নীতিমালা গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন দক্ষ জনশক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও অদক্ষদের বেলায় খুবই রুঢ়। আবার অর্থনীতির প্রয়োজনেই প্রতিবেশী দেশ থেকে লোক আসার পথ বন্ধ করেও দেয় না। এসব কারণেই আমেরিকায় ‘আনডুকমেন্টেড’ জনগোষ্ঠী এতো বেশি। তিনি আমেরিকার অভিবাসনকে অর্থনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন। 

নিউইয়র্কের ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি মৌমিতা রহমানও আমেরিকার অভিবাসন পদ্ধতি অতিমাত্রায় রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে মত দেন। তিনি বলেন, অভিবাসন সংক্রান্ত প্রতিটি আইনই হয়েছে রাজনীতির কারণে ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। অপছন্দের লোকদের আমেরিকার বাইরে রাখার লক্ষ্য নিয়েই দেশটির অভিবাসন নীতি ও কাঠামো সাজানো হয়। 

মৌমিতা রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সবসময়ই অভিবাসন বিরোধী মনোভাব ছিল। গত চার বছরে তা অনেক বেড়েছে। অভিবাসন বিরোধী মনোভাবের কারণে এ সময় বিশ্বের অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলার সেবা, ভিসা দেওয়া সংক্রান্ত কাজ গুটিয়ে ফেলেছে।বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় লোক আসা নিয়ন্ত্রণ করতে ট্রাম্প প্রশাসন এসব করেছে। 

বাইডেনের অভিবাসন সংস্কার নীতিকে অভিবাসন ও অবৈধদের বৈধতা পাওয়ার সহজ পথ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, তার প্রস্তাবনায় অবৈধদের বৈধতা পাওয়ার আবেদন করার ক্ষেত্রে কঠিন কোনো পূর্ব শর্ত রাখা হয়নি।  

তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইমিগ্রেশন কোর্টে দায়িত্বে থাকা ট্রাম্প আমলে নিয়োগ পাওয়া ইমিগ্রেশন বিচারকদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ট্রাম্পের সময় বিভিন্ন পেশা থেকে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী থেকে অনেককে ইমিগ্রেশন কোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের অধিকাংশই ইমিগ্রেশন বিরোধী। তাদের অভিবাসন বিরোধী মনোভাব রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নিষ্পত্তিতে প্রভাব পরতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। 

তিনি বলেন, অভিবাসীদের প্রতি নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মনোভাব সামগ্রিকভাবে অভিবাসন সংক্রান্ত কাজে প্রভাব ফেলে। বাইডেন যেহেতু নিজেকে অভিবাসীবান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করছেন, তাই প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার একটি ইতিবাচক ছাপ পরবে বলে তিনি আশা করেন।  

নতুনদেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, আমেরিকার অভিবাসন নীতিমালা ও পদ্ধতি নিয়ে মিডিয়ায় আরো বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, মুসলমানদের যেতে দেওয়া না দেওয়া বা অবৈধদের বৈধতার দেন দরবারের মধ্যেই আমেরিকার অভিবাসন কাঠামোর পরিধি। কিন্তু এই আলোচনায় জানা গেল- এটি তার চেয়েও বিস্তৃত কিছু। তিনি আমেরিকায় অভিবাসনে আগ্রহীদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেনে নিজেদের মতো চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন।

ওএফ