প্লাটফরম এবং ব্যবহারকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কানাডা সরকার যে আইনের প্রস্তাব করেছে তা নাগরিকদের উপকারে আসবে বলে মত দিয়েছেন তিন কানাডিয়ান বিশেষজ্ঞ। তারা বলেছেন, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তদারকি ব্যবস্থা থাকা দরকার।

কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুন দেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের সঞ্চালনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভ’ অনুষ্ঠানে তারা এ মত দেন। আলোচনায় অংশ নেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক খবর পাঠক আসমা  আহমেদ, গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও সাংবাদিক সৈকত রুশদী এবং ব্যারিস্টার ওবায়দুল হক। টরেন্টো সময় বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘কানাডা কেনো সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চায়’ শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

নতুন দেশের প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর কানাডা সরকারের প্রস্তাবিত আইনের রুপরেখা তুলে ধরে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে কানাডা একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেআইনি এবং ক্ষতিকর কোনো বক্তব্য প্রচারিত হলে পুলিশ সোশ্যাল  মিডিয়া  প্লাটফরম এবং বক্তব্য পোস্টকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে। পোষ্টকারী এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় ধরনের জরিমানা এবং কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে প্রস্তাবিত এ আইনে। প্রস্তাবিত আইনের ঘোষণার উদ্ধৃতি দিয়ে শওগাত আলী সাগর বলেন, আইনটির প্রস্তাবক হেরিটেজ মন্ত্রণালয় বলেছে, সামাজিক পরিবেশে কোনো নাগরিকের ক্ষতি করার জন্য অপরাধীকে পুলিশ ধাওয়া করতে পারলে অনলাইন সমাজে ক্ষতিকর ব্যক্তিকে ধাওয়া করার ক্ষমতাও পুলিশের থাকতে পারে।

প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে আলোচনা করে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক খবর পাঠক আসমা আহমেদ বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে কানাডা সরকারের প্রস্তাবিত আইনটিতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা সমাজ এবং মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু পর্ণোগ্রাফি, হেইট স্পিচ এবং বিনা সম্মতিতে কারো অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আইনটিতে।

তিনি বলেন, এ তিনটিই কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলো রক্ষায় রাষ্ট্র এগিয়ে না আসলে কে আসবে। আমি মনে করছি সমাজকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এ ধরনের আইনি পদক্ষেপ যদি আসে এবং যদি তার ভালো তদারকি হয়, তাহলে মানুষ অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে।

আসমা আহমেদ বলেন, কানাডার একটি সংস্থা প্রস্তাবিত আইনটি সম্পর্কে নাগরিকদের মতামত জানার জন্য জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে অধিকাংশ কানাডিয়ানই চায় সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফরমগুলো সরাসরি সরকারের তদারকির আওতায় থাকুক। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও সাংবাদিক সৈকত রুশদী তার আলোচনায় সোশ্যাল মিডিয়া তদারকির জন্য স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় সোশ্যাল মিডিয়া তদারকি ব্যবস্থা থাকা দরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একদিকে যেমন কোনো কোনো দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার আদায়ের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের রায়কে ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টায়ও ব্যবহৃত হয়েছে।

বর্ণবাদী তৎপরতা, উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারণার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার রোধ করতে কাঠামোগত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা দরকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তবে এ তদারকি যেনো কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

ফেসবুক, টুইটারের স্বনিয়ন্ত্রণের ধারণার বিরোধিতা করে সৈকত রুশদী বলেন, জনগণের চিন্তাভাবনা প্রকাশ কিংবা জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কোনো করপোরেশনের হাতে দেওয়া মোটেও উচিত না। তিনি জনগণের নির্বাচনের প্রতিনিধিদের হাতে সোশ্যাল মিডিয়া তদারকির ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট মডারেশনের পাশাপাশি সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে কি-না কিংবা ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কি-না সেগুলো দেখতে হবে। নতুন নতুন যতো প্রযুক্তি আসবে সেগুলো পরিচালনার জন্য পরামর্শমূলক আইনি কাঠামো কানাডায় থাকা উচিত বলে তিনি মত দেন।

ব্যারিস্টার ওবায়েদুল হক সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে কানাডার নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে বলেন, মুনাফার মাধ্যমে পরিচালিত করপোরেশনগুলো স্বনিয়ন্ত্রণ আর রাষ্ট্রের নিজস্ব আইনি কাঠামোর পর্যালোচনা থেকেই কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোকে একটা সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া তদারকির আলাদা আইনের কথা ভাবতে হয়।

তিনি বলেন, কানাডার চার্টার যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে তেমনি অন্যের জন্য ক্ষতিকর এমন বক্তব্য, তথ্য, ভুল বা বিকৃত তথ্য প্রচারণার শাস্তির জন্য আইনি কাঠামো বিদ্যমান আছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে এ আইনগুলো কিভাবে ব্যবহৃত হবে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ফলে সরকারকে একটি আইনি কাঠামোর কথা ভাবতে হয়েছে।

মানুষের কথা বলার অধিকারসহ মৌলিক অধিকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে ভার্চুয়াল জগতে নিরাপত্তা এবং সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতেই এ আইনের কথা ভাবা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ব্যারিস্টার ওবায়েদুল হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং সামাজিক জীবনে আইনের প্রতি যে আনুগত্য থাকে, অনলাইন জীবনেও একই চিন্তার অনুসরণ করলে সবকিছুই সহজ হয়ে যায়।

এমএইচএস