বাঙালি জাতি, একটি সৌভাগ্যবান জাতি। এই জাতির রয়েছে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ইতিহাস! পৃথিবীর অন্যতম শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবেও বাংলা ভাষার রয়েছে স্বীকৃতি। মায়ের কাছেই প্রথম এই ভাষায় কথা বলতে শেখে এই জাতি। তাইতো বাংলাকে বলা হয় মাতৃভাষা।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পুরো জাতির জন্য একরতি বিশেষ দিন। বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণদানের গৌরবোজ্জ্বল মাতৃভাষা আন্দোলনের আজ ৭০ বছর পূর্ণ হলো।

১৯৫২ সালের এইদিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নামে আন্দোলনরত ছাত্ররা। তাদের ওপর নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে তৎকালীন পুলিশ। শহীদ হন এতে কয়েকজন ছাত্র। ভাষার জন্য তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সৃষ্টি করেছিল এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসক বাঙালি জাতিসত্তা বিলীন করে দিতে ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠায় নির্দেশ জারি করেছিল। তখনই এই অযৌক্তিক দাবির প্রতিবাদে বিস্ফোরিত হয় বাঙালি জাতি। জ্বলে উঠে শিক্ষাঙ্গনসহ সারাদেশে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ।

বাংলার ছাত্র-জনতা ওইদিন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে ভিত নড়ে ওঠে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি ছাত্র-জনতার ওপর।

আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর তৎকালীন পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। তাদের মধ্যে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বার অন্যতম। ওইদিন অহিউল্লাহ নামে এক ৮/৯ বছরের কিশোরও নিহত হয়।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরের দিন ছাত্রদের পাশাপাশি রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষও। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা পাক স্বৈরশাসক ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়।

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।

১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের ফলশ্রুতিতেই চুয়ান্নর গণরায়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম এবং অবশেষে একানব্বইয়ের স্বৈরশাসনের অবসান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনের সফলতার মাঝে আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং স্বাধিকার চেতনার বীরোচিত প্রকাশ ঘটেছিলো বিশ্ববাসীর কাছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। পুরো মাসব্যাপী শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমগুলো। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশের ও বিদেশের বাংলা ভাষার সংবাদপত্রগুলোও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি জুড়ে একুশের বইমেলার আয়োজন করে।

লেখক : মুহিব উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক