একটি ইসলামী সংগীত অনুষ্ঠানে জুনায়েদ জামশেদ, ছবি : গেটি ইমেজ

এক জীবনে অনেক জীবনের স্বাদ উদযাপন করতে পারেন কতজন? আবার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে মানুষের সমান ভালোবাসা, হৃদয়ের উষ্ণতা পাওয়ার সৌভাগ্যও কি হয় সবার?- শত মানুষ, শত শত গল্প-ঘটনাপ্রবাহের ভিড়ে খুঁজে ফিরে হয়তো দুয়েকজনের দেখা মেলে কখনও কখনও। এমনি একজন, উপমহাদেশের ইসলামী সংগীতশিল্পী ও পাকিস্তানের এক সময়ের পপস্টার জুনায়েদ জামশেদ।

অভিনেতা ও গায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত ধর্ম-ইসলামের পথে শান্তি খুঁজে নেন তিনি।

তার গাওয়া ‘মেরা দিল বদল দে, মুহাম্মাদকা রওজা’ গজলগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় শ্রোতাদের মাঝে। ইসলামী সংগীত শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও  জীবনের শুরুর গল্পটা ছিল একেবারে ভিন্ন।

পড়াশোনা শেষে প্রাথমিক জীবনে পাইলট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর ইচ্ছা ছিল জুনায়েদের। তবে বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে একজন পেশাদার প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন৷ 

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্র-প্রকৌশলে পড়াশোনার সময় সঙ্গীতটা আরম্ভ করেছিলেন অনেকটা শখের বশেই। গান গাইতে গাইতেই পরিচয় হয় রোহেল হায়াত ও শেহজাদ হাসানের সঙ্গে। তারা মিলেই খোলেন নতুন ব্যান্ড দল ‘ভাইটাল সাইন্স’, যার মূল ভোকালিস্ট ছিলেন জুনাইদ। সময়টা ১৯৮৬ এর মাঝামাঝি।

পরের বছরেই একই নামে বাজারে আসে তাদের অ্যালবাম। সেখান থেকে ‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘তুম মিল গায়ে’ দিয়ে দেশজোড়া খ্যাতি পান জুনাইদ ও তার ব্যান্ড। তারপর তো পড়া ছেড়ে পুরোদস্তুর গানেই মজে গেলেন জুনায়েদ।

বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় এ্যালবাম বেরোবার পর ১৯৯৫ সালে যখন ব্যান্ড ভেঙে যায়, জুনায়েদ জামশেদ তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে আরম্ভ করেন। এতেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন৷ পাকিস্তানের প্রথম পপস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে।

সংগীত শিল্পী হিসেবে জুনায়েদ জামশেদের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে এমন সময় হঠাৎ সঙ্গীত ছেড়ে দেবার ঘোষণা দেন তিনি। ২০০২ সালে সংবাদ সম্মেলন করে জানান এই খবর৷ শেষমেষ ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীতজগতকে বিদায় জানান তিনি৷

এরপরই মিডিয়া ও লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান জুনায়েদ। কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি এরপর খুলে বসলেন ফ্যাশন হাউজ ‘জে ডট’। পাশাপাশি তিনি জড়িয়ে পড়েন তাবলিগ জামাতের সাথেও। তাবলিগের হয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেবার পাশাপাশি তিনি শুরু করলেন নাত (নবীর স্তুতিমূলক গান) গাওয়া। এই নাত দিয়ে আবারো জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন জুনায়েদ জামশেদ। 

জুনায়েদ জামশেদের জীবনের আমুল পরিবর্তনের পেছনে বিশেষ আবদান রয়েছে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তারেক জামিলের। তিনি জুনায়েদ জামশেদকে দ্বীনের পথে ফেরাতে নিরলস প্রচেষ্টা করে যান।  এ নিয়ে মাওলানা তারেক জামিল নিজেই এক ভিডিওতে বলেন,

‘জুনায়েদ যখন সংগীত ছাড়বে কি না -এ নিয়ে দোদুল্যমনতায় ভুগছিল, এমন সময় একদিন জানতে পারলাম, সে আমার কাছে আসতে লজ্জা পাচ্ছে কারণ, আমাকে দাড়ি না কাটার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে তা রক্ষা করতে পারেনি। তাই লজ্জায় আমার কাছে আসছিল না। একথা জেনে আমি বললাম, যেহেতু সে লজ্জা পাচ্ছে, তাই তাকে মুখ ঢেকে আসতে বল আমার কাছে। তবুও ধর্মীয় মজলিস থেকে দূরে সরে যেতে বল না।’

ক্যারিয়ারে সফলতার শীর্ষে থেকে হঠাৎ করেই ধর্মের পথ বেছে পাকিস্তানের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে বিদায় জানানোর কথা বলতে গিয়ে জুনায়েদ জামশেদ বলেন, জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েছে। সংগীতশিল্পী হিসেবে জীবনে বেশ কিছু চমৎকার মুহূর্ত কেটেছে।

জীবনের সোনালী দিনগুলো কাটছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন তার মনে হলো; জীবনের আসল উদ্দেশ্য কি? তিনি কি আজীবন শুধু গানই করে যাবেন? দামি দামি গাড়ি, গ্ল্যামার, আলো ঝলমলে স্টেজ পারফরম্যান্স, তিনি কি শুধু এগুলোর জন্যই পৃথিবীতে এসেছেন?

এই ভাবনাই তার জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনলো। এই ভাবনা থেকে তিনি এক ধরনের মানসিক হতাশার শিকার হতে শুরু করলেন। এই মানসিক হতাশাই তাকে সংগীত জগত ছাড়তে বাধ্য করল।

মিউজিক ছাড়ার সময় জুনায়েদ জামশেদের মাথায় একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল; তাহল মিউজিক ক্যারিয়ার ছেড়ে দেওয়ার পর কি তার ভক্তরা তার আশপাশে ভিড় করবেন এখন যেমনটা করেন?

তবে জুনায়েদ জামশেদের গজলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাংলায় গাওয়া ‘হে রাসূল’ ও ‘নবী মোর পরশমনি’-র কাভারও ইউটিউবের কল্যাণে পেয়েছে বেশ বাঙালি-শ্রোতাপ্রিয়তা। 

৭ ডিসেম্বর ২০১৬ চিত্রাল থেকে ইসলামাবাদ যাওয়ার পথে এক বিমান দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক শাহাদাত বরণ করেন জুনায়েদ জামশেদ। অসাধারণ সব নাতের কারণে পৃথিবী জুড়ে জুনায়েদ জামশেদের অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন। যারা তাকে স্মরণ করেন প্রতি মুহুর্তে।