প্রতীকী ছবি

লোকমান হাকিম। তার জ্ঞান-প্রজ্ঞার পরিচিতি-প্রসিদ্ধি জাহানজুড়ে। তাকে বিশেষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করা হয়েছিল, যেমন খিজির আলাইহিস সালামকে দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার কথাকে কোরআনে মানুষের নসিহত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার নামে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। নিজের ছেলেকে দেওয়া তার উপদেশবাণী বিশ্বখ্যাত। 

সকলের কাছে হাকিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন হজরত লোকমান (আ.)। হাকিম মানে হচ্ছে যার থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বের হয়। তার কথা ছিল অর্থবহ। মানুষের মাঝে এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। এখনো তার কথাকে বাণী হিসেবে লিখে রাখা হয়। 

হজরত লোকমান আ. পেশাগত দিক থেকে ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। জাবির (রা.) তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি বেঁটে, চেপ্টা নাকবিশিষ্ট। আবার ইমাম মুজাহিদ (রহ.) বলেন, তিনি ফাটা পা ও পুরো ঠোঁটবিশিষ্ট ছিলেন।

লোকমান আ. সামান্য আয়ের মানুষ হলেও তিনি কখনো অর্থের জন্য অনৈতিক কাজে জড়াননি। সৎভাবে অর্জিত অর্থ দিয়েই তিনি জীবন চালাতেন। 

হজরত ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বেহ (রহ.) এর মতে, লোকমান (আ.) আইয়ুবের (আ.) ভাগ্নে ছিলেন। তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ইমাম বায়জাবি (রহ.), অন্য মতানুসারে তিনি দাউদ (আ.)-এর সময়ও জীবিত ছিলেন। ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনায় আছে, লোকমান (আ.) আবিসিনীয় ক্রীতদাস।

লোকমান হাকিম নবী ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। ইবনু আববাস (রা.), জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) এবং সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রা. এর বর্ণনা উদ্ধৃত করে সুফিয়ান সাওরি রহ. তিনি নবী নন, বরং আল্লাহর একজন সৎ বান্দা ছিলেন। ইমাম বাগবি (রহ.) বলেন, এ কথা সর্বসম্মত, তিনি নবী নন; বরং ফকিহ ও প্রাজ্ঞজন। -(মাজহারি, ইবনে কাছীর, তাফসীর সূরা লোকমান ৩১/১২ আয়াত)।

সাহাবি কাতাদা (রা.)-কে উদ্ধৃত করে হজরত ইবনু কাসির (রহ.) বলেন, মহান আল্লাহ লোকমান (আ.)-কে ‘নবুয়ত’ ও ‘হিকমাতে’র (প্রজ্ঞা) মধ্যে একটি গ্রহণের অবকাশ দেন। তখন তিনি হিকমত (প্রজ্ঞা) গ্রহণ করেন। 

কেউ একজন তাকে নবুয়ত গ্রহণ না করার কারণ জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, ‘যদি আমাকে নবুওয়াত দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হত; তাহলে আমি তা গ্রহণ করলে আল্লাহর সাহায্য পেয়ে তাতে সফল হতাম। কিন্তু তা চূড়ান্ত না করে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, যে কারণে এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমি শঙ্কিত ছিলাম। তাই আমি হেকমতকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা গ্রহণ করেছি।’ 

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, লোকমান হাকিম বলেছেন, যে গুণগুলোর কারণে আল্লাহ তায়ালা আমাকে এত ওপরে উঠিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি যদি সেগুলো অর্জন করতে পারেন তাহলে সেও আমার মতো মর্যাদার আসনে সমাসিন হতে পারবেন। সে গুণগুলো হচ্ছে, নিজের দৃষ্টিকে নিচের দিকে রাখা, জবানকে বন্ধ রাখা তথা চুপ থাকা, হালাল আয়ের ওপর সন্তুষ্ট থাকা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করা, সত্য কথা বলা, অঙ্গিকার পূর্ণ করা, মেহমানের ইজ্জত করা, প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়া, অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।

জানা গেছে, লোকমান হাকিমকে একলোক এসে বলে, তুমি ওই ব্যক্তি না, যে আমার সঙ্গে মাঠে ছাগল চড়িয়েছ? আচ্ছ বলো তো, তুমি এত বড় হলে কীভাবে, লোকজন দূরদূরান্ত থেকে তোমার কথা শুনার জন্য আসে এবং তোমার এত বড়বড় মজলিস বসে? উত্তরে তিনি দুটি গুণের কথা বলেন। দুটি গুণের কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাকে এত বড় করেছেন। (এক) সদা সত্য কথা বলা। (দুই) অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা।

সাহাবি আবু দারদা (রা.) এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি ছিলেন নিরবতা অবলম্বণকারী, সর্বদা চিন্তায় নিমগ্ন ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি। দিনে কখনো ঘুমাতেন না। কেউ তাকে থুথু ফেলা, নাক পরিস্কার ইত্যাদি মানবীয় কাজ করতে দেখেননি (অর্থাৎ এগুলো তিনি নিরবে সেরে ফেলতেন)। (ইবনে কাসির)