প্রতীকী ছবি

সন্তান জন্মের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহর নামে পশু কোরবানি করাকে শরিয়তে আকিকা বলে। আকিকা করা মুস্তাহাব। মহানবী (সা.) নাতি হাসান ও হোসাইন দুজনের পক্ষ থেকে আকিকা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এর ওপর আমল করেছেন। 

সন্তানের জন্মগ্রহণ পিতা-মাতার জন্য চরম আনন্দের। এজন্যই শরিয়ত এ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আকিকার নির্দেশ করেছে। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে বলেছে। বাচ্চার আকিকা না করা হলে বাচ্চা বিপদ-আপদে জর্জরিত থাকে। আকিকা হয় তার ফিদিয়া বা বিনিময়। এর দ্বারা বাচ্চার বিপদ-আপদ দূর হয়। 

সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটা ছেলে আকিকার বিনিময়ে বন্ধক থাকে। অতএব তার পক্ষ থেকে সপ্তম দিন পশু জবাই করা হবে, তার নাম রাখা হবে এবং মাথা মুণ্ডানো হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫২২)

বাচ্চার আকিকা করার কারণে কিয়ামতের দিন বাবা সন্তানের সুপারিশের উপযুক্ত হবে। এছাড়াও আকিকার মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে মহব্বত-ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। কারণ, নবজাতকের খুশিতে একই দস্তরখানে ধনী-গরিব সবার সম্মিলট ঘটে। 

আকিকা কে করবে

সন্তান যেহেতু মা-বাবার জন্য নিয়ামত এজন্য আকিকাও তাদেরই করা দায়িত্ব। মা-বাবার সামর্থ না থাকলে দাদা-দাদি, নানা-নানি করতে পারবে।  

আকিকার জন্য কয়টি পশু লাগবে

ছেলেসন্তান হলে একই ধরনের দুটি বকরি আর কন্যাসন্তান হলে একটি বকরি জবাই করতে হয়। ছেলের জন্য গাভী, উট, মহিষের দুই অংশ এবং মেয়ে হলে এগুলোর এক অংশ জবাই করা কিংবা ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই বড় পূর্ণ পশু দ্বারা আকিকা করা সবই জায়েজ। 

কারও সামর্থ না থাকলে ছেলের জন্য একটি বকরি আকিকা করলেও কোনো অসুবিধা নেই। যদিও দুটি করা উত্তম। (তানকিহুল হামিদিয়া : ২/২৩৩) কেউ কোনো আকিকা না করলেও অসুবিধা নেই; কেননা আকিকা করা মুস্তাহাব আমল। ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক নয়। (বেহেশতি জেওর : ৩/৪৩)
কন্যাসন্তানের জন্য কি মাদি পশু আকিকা করতে হয়?

অনেকেই মনে করে, ছেলেসন্তান হলে নর পশু আর মেয়ে হলে মাদি পশু আকিকা করতে হয়। মহানবী (সা.) তাদের এ ধারণার অপনোদন করেছেন। উম্মে কুরজ (রা.) রাসুল (সা.)-কে আকিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ছেলের জন্য দুই বকরি এবং মেয়ের জন্য এক বকরি। পশুগুলো নর-মাদী হওয়া তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫১৬)

আকিকার পশুর ধরন

কোরবানিতে যেসব পশু জবাই করা যায় আকিকায়ও সেসব পশু জবাই করা যায়। অর্থাৎ উট, গাভী, মহিষ, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা। তাই কোরবানি চলে এমন পশুই আকিকার জন্য নির্বাচন করতে হবে।  

আকিকার সময়

আকিকার জন্য সবচেয়ে উত্তম সময় জন্মের সপ্তম দিন। সপ্তম দিনে করতে না পারলে চৌদ্দতম দিন। তাতেও না পারা গেলে একুশতম দিনে আকিকা করা। একুশতম দিনের পর সময়ের ফজিলত শেষ হয়ে যায়। আর তখন সেটি মুবাহ হিসেবে থাকে। আদায় করলে আদায় হয়। তারপরও যখনই আকিকা করার ইচ্ছা হবে, উত্তম হলো জন্মদিনের হিসাবে সপ্তম দিনে করা। অর্থাৎ বাচ্চা যে বারে জন্মগ্রহণ করেছে এর আগের বারে আকিকা করলে সপ্তম দিনের মুস্তাহাব আদায় হয়ে যাবে। যেমন কোনো বাচ্চা মঙ্গলবারে জন্মগ্রহণ করলে সোমবারে তার আকিকা করে দেওয়া। (আল-মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন; আল মুগনি লিইবনি কুদামা : ১৩/৩৯৬)

অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে, যে সময় বাচ্চার মাথায় ক্ষুর রাখা হবে এবং নাপিত মাথা মুণ্ডানো শুরু করবে ঠিক তখন বকরি জবাই হবে। এটা নিতান্তই রুসম-রেওয়াজ ছাড়া কিছুই নয়। আকিকার আগে-পরে যেকোনো সময় পশু জবাই করা যাবে। তবে জবাইয়ের আগে মাথা মুণ্ডিয়ে নেওয়া উত্তম। 

জন্মের পূর্বে আকিকা করা

জন্মের পূর্বে আকিকা করা জায়েজ নেই। কেউ করলে তার আকিকা আদায় হবে না; বরং এ জবাই হবে শুধুই গোশত খাওয়ার জন্য। (আল-মাজমু শরহুত তাহজিব : ৯/২৪৫)
মূল্য সদকার চেয়ে আকিকা করাই উত্তম

পশুর মূল্য সদকার চেয়ে পশু জবাই করে আকিকা করাই উত্তম। কেননা এখানে রক্ত প্রবাহিত করাই উদ্দেশ্য। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় অনেক গরিব-অসহায় সাহাবি থাকা সত্ত্বেও তিনি মূল্য সদকা না করে আকিকা করেছেন। (আল মুগনি লিইবনি কুদামা : ১৩/৩৯৫)

কোরবানির সঙ্গে আকিকা দেওয়া

একই বড় পশুতে কোরবানি ও আকিকা উভয়টি দেওয়া যায়। আকিকার নিয়তে শরিক হতে চাইলে গাভী, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে মেয়ের জন্য এক অংশ এবং ছেলের জন্য দুই অংশ নিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬) কোরবানি ছাড়াও বড় পশুতে আকিকার নিয়ত করা যায়।  

আকিকার পশু জবাইয়ের দোয়া

আকিকার পশু জবাইয়ের সময় জবাইকারী পড়বে-বিসমিল্লাহি ওয়া আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা লাকা ওয়া ইলাইকা আকিকাতু ফুলান। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার নামে এবং তিনি সবচেয়ে বড়। হে আল্লাহ, এটা শুধু আপনার সন্তুষ্টির জন্য আপনার দরবারে অমুকের আকিকার পশু জবাই করছি।

 এ দোয়াটিও পড়বে-আল্লাহুম্মা হাজিহি আকিকাতু ইবনি ফাইন্না দামাহা বিদামিহি ওয়া লাহমিহা বিলাহমিহি ওয়া আজমিহা বিআজমিহি ওয়া জিলদিহা বিজিলদিহি ওয়া শাঅরিহা বিশারিহি, আল্লাহুম্মাজলহা ফিদাআন লিইবনি মিনান-নার। অর্থাৎ হে আল্লাহ, এটা আমার ছেলে/মেয়ের আকিকা। তাই তার রক্ত তার রক্তের বিনিময়ে, তার গোশত তার গোশতের বিনিময়ে, তার হাড্ডি তার হাড্ডির বিনিময়ে, তার চামড়া তার চামড়ার বিনিময়ে। হে আল্লাহ, তাকে আমার ছেলে/মেয়ের বিনিময়ে দোজখ থেকে মুক্তির বিনিময় বানিয়ে দিন।  

আকিকার গোশতের বিধান

আকিকার গোশতের বিধানও কোরবানির মতোই। কাঁচা গোশতও বিতরণ করা যায় আবার রান্না করে দাওয়াত করেও খাওয়ানো যায়। আকিকার গোশত নিজে এবং মা-বাবা, দাদা-দাদি এবং নানা-নানিসহ সবাই খেতে পারবে। ধনী আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশিকে হাদিয়া দিতে পারবে এবং গরিব-অসহায়দের সদকা করতে পারবে। সব গোশত নিজের জন্য রেখে দেওয়াও জায়েজ। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৭৯৬৭) 

আকিকার পশুর হাড্ডি ও চামড়ার বিধান

আকিকার পশুর হাড্ডি ও চামড়ার বিধান কোরবানির মতোই। বিক্রি করে এগুলোর মূল্য নিজে ব্যবহার করা কিংবা আকিকার খাবারে ব্যয় করা জায়েজ নেই; বরং তার মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। হ্যাঁ, বিক্রি না করে নিজে ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধা নেই। (হিন্দিয়া : ৫/৩০১)

মৃত বাচ্চার আকিকা

মৃত বাচ্চার আকিকার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। (ফাতাওয়া রহিমিয়া : ১০/৬১)

লেখক : শিক্ষাসচিব ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ