আল্লামা মুহাম্মদ রাবে হাসানি নদভি—বিশ্বনন্দিত আলোকিত নাম, জনপ্রিয় প্রভাবক ব্যাক্তিত্ব। কল্যাণের পথে আহবানে তিনি ছিলেন চিরজাগ্রত কর্মবীর। ছিলেন এশিয়া উপমহাদেশেসহ আরব দুনিয়ার অন্যতম সর্বজনবিদিত প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী। 

ভারত উপমহাদেশের ইসলামিক স্কলার জগদ্বিখ্যাত আলেমেদ্বীন আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি রাহিমাহুল্লাহর প্রিয়তম ভাগিনা। মামার মতো কর্মবহুল কীর্তিময় ছিল তার জীবন। দেখতে সাধারণ একজন মানুষ। গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন; প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছল। গুণ ও প্রজ্ঞার উপমায় সমকালীন আলেম নক্ষত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো দীপ্তিময়। তাঁর বর্ণাঢ্য ও কর্মমুখর জীবনের সারাংশ তুলে ধরা হলো—

প্রথম জীবন ও পরিবার

মুসলিম ইতিহাসের খ্যাতনামা এ আলেমেদ্বীনের জন্ম ৬ জুমাদাল উলা ১৩৪৮ হিজরি সন— ২ অক্টোবর ১৯২৯ সালে। ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সূতিকাগার উত্তর প্রবেশের রাজধানী লাখনৌর রায়বেরেলীর তাকিয়া কেলার সম্ভান্ত্র ও দ্বীনদার ‘হাসানি’ পরিবারে। তার পূর্বপুরুষরা হিজরি ষষ্ঠ শতকে হিন্দুস্তানে পাড়ি জমান এবং উত্তর ভারতে বসবাস শুরু করেন। তারা মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে রায়বেরেলীতে স্থায়ীভাবে নিবাস গড়ে তোলেন। 

এ মহামনীষী ইলম ও আধ্যাত্মিকতার সুনিবিড় ছায়ায় প্রতিপালিত হন। তার বাবা রশিদ আহমদ বিন খলিলুদ্দিন হাসানি রাহিমাহুল্লাহ, আর মা—সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি রাহিমাহুল্লাহর সহোদরা বোন ও প্রখ্যাত বুযুর্গ ও আধ্যাত্মিক প্রাণপুরুষ শায়খ জিয়াউদ্দিন নবির কন্যা পুণ্যবতী খায়রুন্নিসার দুহিতা সাইয়েদা আমাতুল আজিজ।

শিক্ষাজীবন 

পড়ালেখার হাতেখড়ি মা-বাবা কাছেই। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন নিউ এলাকায়। এরপর পাড়ি জমান লখনৌতে, সেখানে তিনি মামা ডক্টর আবদুল আলি আল-হাসানি ও সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভির আন্তরিক সান্নিধ্য ও সুনিবিড় তত্ত্বাবধান লাভে ধন্য হন। 

এছাড়াও তিনি তার মামা দুনিয়াবিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার কাছে আরবি ভাষা-সাহিত্য ও শরয়ি জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষালাভ করেন। 

এরপর ভারতের লাখনৌর বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় ভর্তি হন। সেখানে সমকালীন জগদ্বিখ্যাত ও যুগশ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষীদের কাছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা ও পাণ্ডিত্য লাভ করেন। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্ব আবদুল কাদির রায়পুরি, উপমহাদেশের অন্যতম হাদিসবিশারদ শায়খ জাকারিয়া কান্ধলভি ও সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ সালে দারুল উলুম নদওযাতুল উলামায় সমাপ্ত হয় তার শিক্ষাজীবন।

কর্মজীবন 

শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪৯ সালে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে তিনি আপন কর্মজীবন শুরু করেন। জীবনের সূচনালগ্ন থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি লাভ করেন সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভির স্নেহ ও ভালোবাসার সান্নিধ্যের সৌরভ। বিভিন্ন সফরে তার সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। 

১৯৫০ সালে তিনি তার সাথে হিজাযে সফর করেন, সেখানে এক বছরের বেশি সময় শিক্ষা-দীক্ষা ও নানান অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজের জ্ঞানের ঝুলি সুসমৃদ্ধ করেছেন। দেশে ফিরে ১৯৫২ সালে তিনি একই প্রতিষ্ঠানে আরবি ভাষার সহকারি অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭০ সালে আরবি ভাষা অনুষদের ডীন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। 

১৯৯৩ সালে তৎকালীন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার পরিচালক শায়খ মুহিব্বুল্লাহ নদভির ইন্তিকালের পর তিনি পরিচালকের পদ অলংকৃত করেন। এরপর ১৯৯৮ সালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন হন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্বনন্দিত ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি রাহিমাহুল্লার ইন্তিকালের পর ৩ জানুয়ারি ২০০০ সালে তিনি নদওয়াতুল উলামার প্রধান নির্বাচিত হয়ে অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমি ইন্তিকাল করলে ২০০৩ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন।

দেশভ্রমণ 

মুসলিম বিশ্বের কিংবদন্তি এ আলেমেদ্বীন ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। পবিত্র মক্কা, মদিনা, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, তুরস্ক, মিশর, ইয়ামেন, কুয়েত, আরব আমিরাত, সিরিয়া, লেবানন, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভূটান, জাপান, ব্রিটেন, আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বিভিন্ন ইলমি সফরে গমন করেন। এসব সফরে তিনি ভ্রমণ করেন বহু নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 

এছাড়াও বিভিন্ন ইলমি মজলিস, সভা-সেমিনার ও সাহিত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নিজের জাত চিনিয়েছেন বিশ্বকে। যা তাকে প্রথমত গোটা ভারতবর্ষে ও পরবর্তীতে বৈশ্বিক সুনাম-সুখ্যাতি এনে দেয়। 

লেখালেখির জগতে পদচারণা ও রচনাবলি

প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত তিনি। তার কলমের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে হাজার বছরের ইসলামি ইতিহাসের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়গুলো। সিরাত থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে দর্শন ও সাহিত্য পর্যন্ত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। উর্দু থেকে তার আরবি রচনা যেন অধিকতর অনবদ্য। 

আল্লামা রাবে হাসানি নদভি যেমন পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে ভারতীয় উত্তর প্রবেশ কাউন্সিল ও রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় ও অন্তর্জাতিক বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন।

জনপ্রিয় এ লেখকের হাত ধরে প্রকাশিত হয় অনেক কালজয়ী গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা। ১৯৫৯ সালে তিনি আরবি ভাষায় অর্ধমাসিক আর-রায়িদ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি নদওয়াতুল উলামা থেকে ‘আল বাআসুল ইসলামি’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেখানেও নিয়মিত লিখে যান প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এছাড়াও তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়: তামিরে হায়াত (উর্দু), সাচ্চা রাহি (হিন্দি) ও The Fragrance of East (ইংরেজি)।          

লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থাদি

১. কীমাতুল উম্মাতিল ইসলামিয়া ওয়ামুনজাযাতুহা (আরবি ও উরদু) ২. মাকালাত ফিত তারবিয়াতি ওয়াত তালিম (আরবি ও উরদু) ৩. মানসুরাত মিন আদাবিল আরব (আরবি) ৪. তারিখূল আদাবিল আরবি আল-আসরুল জাহিলি ওয়াল আসরুল ইসলামি (আরবি) ৫. আল-আদাবুল ইসলামি ওয়াসিলাতুহু বিল হায়াত (আরবি) ৬. আল-আদাবুল ইসলামি ফিকরাতুহু ওয়ামিনহাজুহু (আরবি) ৭. রাসায়িলুল আ-লাম (আরবি) ৮. মুআল্লিামুল ইনশা ৩য় খণ্ড (আরবি ও উরদু) ৯. মুখতারাতুশ শেয়র ২য় খণ্ড (আরবি) ১০. আল-আদাবুল আরাবি বায়না আরদিন ওয়ানাকদিন (আরবি) ১১. আদওয়া আলাল আদাবিল ইসলামি (আরবি ও উরদু) ১২. আল-আলামুল ইসলামি কাজায়া ওয়াহুলুল (আরবি) ১৩. ফি যিলালিস সিরাতিন নববিয়্যা (আরবি ও উরদু) ১৪. আদওয়া আলাল ফিকহিল ইসলামি (আরবি) ১৫. রিসালাতুল মুনাসাবাত ইসলামিয়া (আরবি) ১৬. আল-গাজলুল উরদিয়্যু ওয়ামুহাবিরুহু (আরবি) ১৭. বায়নাত তাসাওউফ ওয়াল হায়াত (শায়খ আবদুল বারি নদভি রচিত উরদু থেকে আরবিতে অনূদিত) ১৮. আশ-শায়খ আবুল হাসান আলি আল-হাসনি আন-নদভি শাখসিয়্যাতুন সানাআতিত তারিখ (আরবি ও উরদু) ১৯. সিরাজাম মুনিরা সিরাতু খাতামিন নাবিয়্যিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আরবি, উরদু, ইংরেজি ও হিন্দি) ২০. আল-হিদায়াতুল কুরআনিয়্যা সাফিনাতু নাজাতিন লিল ইনসানিয়্যা (আরবি, উরদু ও হিন্দি) ২১. ফি ওয়াতানিল ইমামিল বুখারি।      

সামাজিক পরিচিতি

আল্লামা রাবে হাসানি নদভি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সদস্য ছিলেন। 

১. লাখনৌর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার প্রধান। ২. ভারতের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতি। ৩. রাবেতা আলমে ইসলামির সহ-সভাপতি ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান। ৪. লাখনৌর আবুল কালাম আজাদ একাডেমির সদস্য ৫. মক্কা ভিত্তিক মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ৬. অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সদস্য ৭. দারুল উলুম দেওবন্দের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ৮. ভারতের উত্তর প্রবেশের দ্বীনি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ শ খানেক আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। 

ইসলামের এ কিংবদন্তি আলেম, মহিরুহ ২১ রমজান ১৪৪৪ হিজরি মোতাবেক ১৩ এপ্রিল ২০২৩ সালে বৃহস্পতিবার বিকাল ৪ ঘটিকায় এক মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে রফিকে আলার সান্নিধ্যে চিরপ্রস্থান করেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুক। আ-মিন।

 লেখক : তরুণ আলেম, শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক