প্রতীকী ছবি

সত্য বলার গুরুত্ব অপরিসীম। সত্য মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা ধ্বংস ডেকে আনে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা মুসলমানদের কর্তব্য। তবে মানুষের দুর্বলতা-অক্ষমতা বিবেচনায়, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং শত্রুকে পরাভূত করতে ক্ষেত্র বিশেষে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে ইসলাম।

তিন স্থানে মিথ্যা বলার অনুমতি থাকার কথা হাদিসে এসেছে। আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন অবস্থা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মিথ্যা বলা বৈধ নয়। (তা হলো) স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার সঙ্গে স্বামীর মিথ্যা বলা, যুদ্ধক্ষেত্রে মিথ্যা বলা এবং মানুষের মধ্যে বিবাদ নিরসনে মিথ্যা বলা।’ (তিরমিজি, হাদিস ১৯৩৯; আবু দাউদ, হাদিস ৪৯২১) 

সংসার সুখের করতে

দাম্পত্য কলহ বা সাংসারিক মনোমালিন্য এড়াতে অথবা সংসার সুখের করতে স্বামী-স্ত্রীর দুজনেরই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে অতিরিক্ত প্রশংসা করা দোষণীয় নয়। এদিকেই ইঙ্গিত করে উম্মু কুলসুম বিনতে উকবা ইবনে আবি মুআইত (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের বিবাদ মিটিয়ে দেয়, কল্যাণের কথা বলে এবং কল্যাণ বাড়ায় সে মিথ্যুক নয়।’

ইমাম ইবনে শিহাব (রহ.) বলেন, ‘মানুষ যেসব বিষয়ে (সাধারণত) মিথ্যা বলে তাতে মিথ্যা বলার অনুমতি থাকার কথা আমি কখনও শুনিনি। তবে তিনটি বিষয় ছাড়া- যুদ্ধ, মানুষের বিবাদ নিরসন এবং স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর কথোপকথন বা স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর কথোপকথন।’ (মুসলিম, হাদিস ২০৬৫)

তবে সেই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা বলার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। কারণ স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরে মিথ্যা বলার অর্থ হলো- সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও সংসার টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসা-প্রেমের বহিঃপ্রকাশ করার ক্ষেত্রে কৌশলী হওয়া। যেমন স্বামী বলতে পারবে- ‘তুমি অনেক সুন্দর মাশাআল্লাহ’, ‘তুমি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’, পৃথিবীতে তুমিই আমার আপনজন’, ‘আমার চোখে তুমিই পৃথিবীর সুন্দরতম নারী’ ইত্যাদি। তবে মিথ্যা বলার সুযোগ থাকার অর্থ মোটেও কারো অধিকার খর্ব করা বা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ানো নয়। 

শান্তির খোঁজে ও ক্ষতি এড়াতে

ইমাম বাগাভি (রহ.) আবু সুলাইমান আল-খাত্তাবির সূত্রে বলেন, ‘শান্তির খোঁজে এবং ক্ষতি এড়াতে এ বিষয়গুলোতে বাড়িয়ে বলা এবং সত্য অতিক্রম করার জন্য কখনো-সখনো মানুষ অপারগ হয়ে পড়ে। এ কারণেই যেখানে মীমাংসার সম্ভাবনা থাকে সেখানে টুকটাক ঝামেলা হলে মিথ্যা বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ... আর স্ত্রীর সঙ্গে মিথ্যা বলার অর্থ হলো তাকে গুরুত্ব দেওয়া, আপন করে নেওয়া, অন্তরে যতটুকু ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা, এর মাধ্যমে স্থায়ী সম্পর্কের প্রচেষ্টা করা এবং তার চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করা।’ (শারহুস সুন্নাহ : ১৩/১১৯)

শুধু সংসারেই নয়, দুটি মানুষের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিতেও এমন কৌশলী হওয়ার অনুমতির কথা হাদিসে বলা হয়েছে। তাই দাম্পত্য কলহ নিরসনে তা আরও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে। সুফইয়ান ইবনে উইয়াইনা বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কারো কাছে অপারগ হয়ে পড়ার কারণে তাকে সন্তুষ্ট করতে কথা বানায় এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে, সে মিথ্যাবাদী হবে না। কারণ হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয় সে মিথ্যাবাদী নয়।’

সুফইয়ান ইবনে উইয়াইনা বলেন, ‘সুতরাং সাধারণ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার চেয়ে নিজের জীবনসঙ্গীর সঙ্গে মীমাংসা করা উত্তম।’

পৃথিবীতে সব মানুষের সংসার ভালোবাসায় ভরপুর থাকে না। ঝগড়া-বিবাদ ও দাম্পত্য কলহে অনেক সংসার ভেঙে যায়। তাই সাংসারিক জীবনে এক সঙ্গে চলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার বিকল্প থাকে না।

সত্যের আশ্রয় ও খলিফার বক্তব্য

উমর (রা.)-এর যুগে এক লোক স্ত্রীকে বললো, ‘তোমাকে আল্লাহর কসম করে বলছি- তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’ সে বলল, ‘আল্লাহর কসম করেই যেহেতু বলেছো, তাহলে (আমি বলব) ‘না’।’ লোকটি বের হয়ে গেলো এবং উমর (রা.)-এর কাছে নালিশ করলো।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কিছু অধিকার থাকে— যা আদায় করা পরস্পরের দায়িত্ব। সেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া মোটেও ইসলাম অনুমোদন করে না। তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর এমন কিছু বিষয় থাকে, যাতে একে অন্যের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না। সেসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা বলাও শরিয়ত অনুমোদন করে না।

ইমাম নাবাবি (রা.) ‘শারহু মুসলিম’-এ বলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর মিথ্যা বলা এবং স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর মিথ্যা বলার অনুমতি থাকার অর্থ হলো- পরস্পরের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো, আবশ্যক নয় এমন বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া— ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা বলা। তবে স্বামীর জন্য বা স্ত্রীর জন্য আবশ্যক এমন কোনো বিষয় থেকে বঞ্চিত করার জন্য অথবা স্বামীর বা স্ত্রীর অধিকার নেই এমন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য প্রতারণা করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।’ 

তাই স্ত্রীর অধিকার খর্ব করা যেমন স্বামীর জন্য বৈধ নয়, তেমনি স্বামীর অধিকার খর্ব করাও স্ত্রীর জন্য বৈধ নয়। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর মতামতের যেমন সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা পাওয়ারও অধিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া এবং গোঁজামিল করা শরিয়তসম্মত নয়। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ ‘ফাতহুল বারি’-তে বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মিথ্যা বলা সেসব বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য, যেসব বিষয়ে স্বামী বা স্ত্রী অপরজনের অধিকার খর্ব করবে না অথবা স্বামী বা স্ত্রীর অধিকার নেই এমন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।’

ইসলামকিউঅ্যাডটনেট অবলম্বনে