ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। কারণ, সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর। আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ্য ও বিশ্বস্ততায় তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভরপুর হওয়াই আবশ্যিক।

নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার অধিকার শ্রমিক ও মালিক উভয়ের রয়েছে। তাই শরিয়তে উভয়কে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে বলা হয়েছে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত ও পরিমিত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে— মর্যাদার ক্ষেত্রে সব শ্রমিক সাধারণভাবে সমান। তবে অবশ্যই শ্রমের শ্রেণিবিন্যাস স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। কিন্তু রাসুল (সা.) ব্যবসা, কৃষি ও দ্বীনচর্চাকে উৎসাহিত করেছেন।

দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান শ্রমিক
শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু। ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে। কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয় আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ২৬)

পরবর্তী আয়াতে নিয়োগদাতা শোয়াইব (আ.)-এর সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত মুসা (আ.)-এর মজুরি নির্ধারণের বিবরণ এসেছে। পরে বিরোধ এড়াতে উভয়ের সম্মতিতে প্রথমেই মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

মালিক ও শ্রমিকের মর্যাদা
ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন খাবার ও বস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছে। এটি ইসলামি শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই নির্দেশনার আলোকে বোঝা যায়, ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়, সে কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে। (বুখারি, হাদিস : ৫৬১৭)

শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকেরই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মালিকানাধীন (অধীন) ব্যক্তির জন্য খাবার ও কাপড়ের অধিকার রয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ১৬৬২)

অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘যে আমাদের কর্মী নিযুক্ত হয়েছে সে যেন (প্রতিষ্ঠানের খরচে) স্ত্রীর ব্যবস্থা করে নেয়, সেবক না থাকলে সে যেন একজন সেবক-খাদেম সংগ্রহ করে এবং বাসস্থান না থাকলে— যেন একটি বাসস্থান সংগ্রহ করে। যে ব্যক্তি এর অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করবে, সে প্রতারক বা চোর গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৯৪৫)

বেতন না আদায়ের শাস্তি
ইসলাম কর্মজীবীর বেতন ও পারিশ্রমিক দ্রুততম সময়ে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৪৩০)

অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ধনী ব্যক্তির টালবাহানা অবিচার। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৮৭); অর্থাৎ সামর্থ্য থাকার পরও মানুষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা বড় অন্যায়।

 ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ভয়ংকর অপরাধ। মহানবী (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব। ... আর একজন সে যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তা থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি। (বুখারি, হাদিস : ২২২৭)

ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি শুধু ইসলামেই
শ্রমিকের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা এবং মালিকের প্রাপ্য সেবা লাভের এমন ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। উল্লেখিত হাদিসে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের নামে মালিক ও উদ্যোক্তার মেধা-শ্রম ও সামাজিক মর্যাদা কেড়ে নেয়নি ইসলাম। নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থাও চাপিয়ে দেয়নি। বরং তাদের অন্তরে মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রমিকের প্রতি মমতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না— যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৭১)

শ্রমিক ঠকানো জঘন্যতম পাপ
উল্লিখিত আয়াতে যেমন মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তার অহংবোধ ও শ্রেণিবৈষম্যের ধারণার নিন্দা করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদের প্রকৃত মালিকানা ও তা অর্জন করতে পারা যে একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগী হয়।

ইসলামের দৃষ্টি শ্রমিক ঠকানো জঘন্যতম পাপ; বরং ইসলামের নির্দেশনা হলো, শ্রমিক তার প্রাপ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলেও মালিক তাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। মহানবী (সা.) এই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না— সেই জাতি কখনো পবিত্র হতে পারে না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২৬)

মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।