গিবত বা পরনিন্দা মানুষের ভেতরকার শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্টকারী এক ঘৃণ্য অপরাধ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে এটাকে নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো অরুচিকর ঘৃণিত কাজের সঙ্গে তুলনা করেছে। আর হাদিস শরিফে ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক অপরাধ বলা হয়েছে।

আমি, আপনি ও আমাদের সমাজের প্রায় মানুষ গিবতকে খুবই মামুলী বিষয় ভেবে নিচ্ছি। একে অপরের দোষচর্চাকে কোনোভাবেই দোষনীয় ও দূষণীয় মনে করছি না। ফলে গিবত বর্জনের কার্যকর কোনো প্রচেষ্টাও আমাদের নেই।

ভাইয়ের দুর্নাম মানে গিবত
অথচ নবীজি (সা.) সবসময় সাহাবিদের গিবত থেকে সতর্ক করতেন। একবার রাসুল (সা.) বললেন, ‘গিবত কী, তা কি তোমরা জান?  সাহাবারা বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। নবীজি (সা.) তখন বললেন, গিবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যা বলি- তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, এটাও কি গিবত হবে? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে— তাহলেই তা গিবত। আর যদি তার মধ্যে না থাকে— তাহলে তো তা অপবাদ।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯০)

গিবত সাধারণত কোনো অবস্থাতেই বৈধতা পায় না। গিবত করার মতো এটা শোনাও গুনাহের কাজ। গিবতের কারণে নিন্দুক যেমন দুনিয়াতেই অধঃপতিত হয়, তেমনি আখেরাতেও রয়েছে তার জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, 'যখন আমার প্রতিপালক আমাকে মিরাজে নিয়েছিলেন— তখন আমি এমন একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের হাতের নখগুলো পিতলের নখের মতো। তারা নিজেদের মুখ ও বুক খামচাচ্ছিল এই নখ দিয়ে। তাদের ব্যাপারে জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলেছিলেন, এরা সেইসব অভাগা যারা দুনিয়ায় মানুষের গোশত খেতো এবং অগোচরে সমালোচনা করে তাদের সম্মানহানি করতো।' (মিশকাত, হাদিস : ৪৮৭৪)

কখনো গিবতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নয়
তাই গিবতের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্যে আমাদের করণীয় হলো— গিবতকারীর গিবতে অংশগ্রহণ না করা। তার কথাকে পাত্তা না দেওয়া। তার কথায় আনন্দিত না হওয়া। পারলে সরাসরি বলে দেওয়া যে, আপনি গিবত করছেন— দুঃখিত এই গিবত আমি শুনতে পারবো না। নবীজি (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের অসাক্ষাতে তার সম্মান রক্ষা করে, কিয়ামতের দিন তার সম্মান রক্ষা করা— আল্লাহর কর্তব্য হয়ে পড়বে।' (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৫৪)

নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, 'কোনো মুমিন যদি কারো সামনে অপমানিত হয় এবং তাকে সাহায্য করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে সে সাহায্য না করে, তাহলে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সকল সৃষ্টজীবের সামনে অপমান করবেন।' (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৫৪১৬)

গিবতের পরিণাম খুবই ভয়াবহ
পরনিন্দা বা গিবত মুমিন বান্দার অসৎ গুণ। এটি মানুষের আত্মশক্তিকে বিনষ্ট করে। সামাজিক শান্তি, আস্থাও শ্রদ্ধাবোধকে ভাঙ্গন তৈরি করে। এ ব্যাপারে কোরআন নির্দেশ করছে, 'আর তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভায়ের গোশত খেতে চাইবে ? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। তোমরা আল্লহকে ভয় করো। আল্লহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।' (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১২)

নবীজি (সা.) বলেছেন, 'গিবত বা পরনিন্দা ব্যভিচার থেকেও গুরুতর অপরাধ। সাহাবিগণ জানতে চাইলেন— কীভাবে এটা গুরুতর অপরাধ হতে পারে ?  নবীজি (সা.) বললেন, ব্যভিচার করার পর মানুষ আল্লাহর নিকট তাওবা করলে— তিনি মাফ করবেন। কিন্তু নিন্দুক সে পর্যন্ত আল্লাহর ক্ষমা পাবে না— যতকাল যার নিন্দা করেছে, তার থেকে ক্ষমা না নেবে।' (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৩৫)

পরনিন্দার কারণে নেক আমল মুছে যায়
গিবত কেবল নিন্দুকের নিজের জন্যে ক্ষতি আর অকল্যাণকেই ডেকে আনে। গিবতকারীর দোয়া ও নেক আমল আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তার নেক আমল মুছে যায় ও আমলনামায় পাপাচার বাড়তে থাকে। কিয়ামতের দিন তার হিসাবকে কঠিন করে দিবে এই গিবত এবং ভাইয়ের গোশত খেতে বাধ্য করবে। আল্লহ আমাদের রক্ষা করুন।

ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, গিবতের পাপ থেকে দুই উপায়ে মুক্তি লাভ সম্ভব।  এক. আন্তরিক তাওবা। দুই. নিন্দুক তার নিজের শঠতা ও নীচতা প্রকাশ করে নিন্দিত মানুষের নিকট ক্ষমা চাওয়া।

গীবতের মতো মারাত্মক গুনাহকে সচেতনভাবেই আমাদের এড়িয়ে চলা উচিৎ। এর উপকারিতাও নানাবিধ। আত্মার প্রশান্তির পাশাপাশি সবচেয়ে বড়ো হলো কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। আল্লহ আমাদেরকে পরিচ্ছন্ন জীবন দান করুন। নিন্দার পথ পরিহার করাকে সহজ করুন।