প্রতীকী ছবি

দিনের নামাজ— বা জোহর ও আসরের নামাজে কিরাত আস্তে পড়া হয়। আর মাগরিব, এশা এবং ফজরের নামাজে কিরাত জোরে বা উচ্চস্বরে পড়া হয়। এটা শরিয়তকর্তৃক আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আমল দ্বারা প্রমাণিত।

ফলে এই অনুযায়ী আমল করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য কর্তব্য। তবে কেন এই বিধান এসেছে, তা জানা থাকতে হবে— বিষয়টা এমন নয়। শুধু এতটুকু জানা ও মানা উচিত যে, এটি মহান আল্লাহ তাআলার হুকুম। আল্লাহর রাসুল (সা.) এভাবেই নামাজ পড়েছেন।

উচ্চস্বরে ও নিম্নস্বরে কিরাত পড়ার কারণ

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যেসব নামাজে রাসুল (সা.) আমাদের কিরাত শুনিয়ে পড়েছেন, আমরাও সেসব নামাজে তোমাদের কিরাত শুনিয়ে পড়ি। আর যেসব নামাজে কিরাত নীরবে পড়েছেন, আমরাও সেসব নামাজে কিরাত নীরবে পড়ি।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৯৭০)

আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী (সা.)-এর অনুকরণ ও অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের জন্য তথা যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহ্‌কে বেশি বেশি স্মরণ করে— তার জন্য রাসুলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)

নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখ সেভাবে নামাজ পড়ো।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০০৮; মুসলিম, হাদিস : ৬৭৪)

নবী (সা.) ফজরের নামাজে, মাগরিব ও এশার নামাযের প্রথম দুই রাকাতে শব্দ করে তেলাওয়াত করতেন। আর বাকি নামাজে চুপে চুপে তেলাওয়াত করতেন।

উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার দলিল

জুবাইর বিন মুতয়িম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-কে মাগরিবের নামাজে (সুরা) ‘তুর’ তেলাওয়াত করতে শুনেছি।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৩৫; মুসলিম, হাদিস : ৪৬৩)

আল-বারা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি নবী (সা.)-কে এশার নামাজে ‘ওয়াত ত্বীনি ওয়াজ জাইতুন’ পড়তে শুনেছি। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠের তেলাওয়াত শুনিনি।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৩৩; মুসলিম, হাদিস : ৪৬৪)

আরও জেনে রাখুন : জোহর-আসর নামাজে কিরাত আস্তে পড়ার কারণ 

জিনদের উপস্থিত হওয়া ও নবী (সা.) থেকে কোরআন শোনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস। সে হাদিসে রয়েছে, ‘তিনি তার সাহাবিদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। যখন তাদের কানে কোরআন পৌঁছল, তখন তারা মনোযোগ দিয়ে কোরআন শুনল।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৩৯; মুসলিম, হাদিস ৪৪৯)

এ হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, নবী (সা.) উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করতেন; যাতে করে উপস্থিত লোকেরা শুনতে পায়।

আল্লামা ইবনে কুদামা ও ইমাম নববি (রহ.)-এর বক্তব্য

ইমাম নববী বলেন, ‘সুন্নত হচ্ছে— ফজর, মাগরিব ও এশার দুই রাকাতে এবং জুমার নামাজে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করা। আর জোহর ও আসরের নামাজে এবং মাগরিবের তৃতীয় রাকাতে এবং এশার তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতে চুপেচুপে তেলাওয়াত করা। সুস্পষ্ট সহিহ হাদিসের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব বিধান সাব্যস্ত।’ (আল-মাজমু, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৮৯)

ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, জোহর ও আসরের নামাজে চুপেচুপে তেলাওয়াত করবে। মাগরিব ও এশার নামাযের প্রথম দুই রাকাতে এবং ফজরের নামাজের সব রাকাতে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করবে...।

এর দলিল হচ্ছে— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল। এটি পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে পরবর্তীদের কাছে প্রচারের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। অতএব, কেউ যদি চুপেচুপে পড়ার নামাজে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করে কিংবা উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করার নামাজে চুপেচুপে পড়ে— তাহলে সে সুন্নতের বিপরিত কাজ করলো। তবে এমন করলেও তার নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে।’ (আল-মুগনি, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ২৭০)

এভাবে নামাজ পড়া সুন্নত নাকি ওয়াজিব

প্রথমত এটি শরিয়তের বিধান। ইসলাম এভাবে পড়তে বলেছে, তাই এভাবে পড়তে হয়। প্রত্যেক মাজহাবের ইমামগণ এক্ষেত্রে একমত। আর হানাফি মাজহাব মতে, উল্লেখিত নামাজগুলোতে এভাবে নামাজ পড়া— ইমামের জন্য ওয়াজিব। মুনফারিদ বা একাকী নামাজ আদায়কারীর জন্য সুন্নত।

এছাড়াও জোহর-আসর নামাজ দিনে হয়। আর মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ রাতে আদায় করা হয়। দিনে মানুষ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ হয়ে থাকে। তাই দিনের নামাজের ক্ষেত্রে আস্তে কেরাত পড়ার কথা বলা হয়েছে।

এতে কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। রাতে মানুষের ব্যস্ততা কম থাকে। সাধারণত আওয়াজও থাকে কম। চারদিক থাকে নীরব নিস্তব্ধ। তাই রাতে জোরে পড়ার কথা বলা হয়েছে। মুসল্লিরা এতে ভালোভাবে কোরআন শ্রবণ করতে পারে। (হাশিয়াতুত তাহতাভি আলা মারাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা : ২৫৩; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া,   খণ্ড : ০৭, পৃষ্ঠা : ৪০)

মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজে কিরাত জোরে পড়ার হিকমত

স্বভাবত মানুষ মাগরিব, এশা ও ফজরের সময় কাজকর্ম থেকে ফারেগ থাকে। কথাবার্তা ও বিভিন্ন আওয়াজ থেকেও নীরব থাকে। পাশাপাশি এ সময় পরিবেশও নীরব ও প্রশান্ত থাকে। তাছাড়া এ সময় চিন্তা ও ভাবনা কম থাকে। তাই এ সময়ের কিরাত অন্তরে বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে।

ফলে অন্তর চিন্তামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার কারণে মনোযোগ নির্বিঘ্ন থাকে। কানে শব্দ না আসার কারণে অনুধাবন ও শ্রবণে আগ্রহী হয়। আর রাতের বেলার শব্দ-কথা কান অতিক্রম করে অন্তরে গিয়ে প্রবেশ করে। হৃদয়ে প্রভাব ও ভাবালুতা তৈরি করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইবাদতের জন্য রাতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ০৬)

এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে মিষ্টকণ্ঠের মানুষ ও পাখির আওয়াজ দিনের তুলনায় রাতে অনেক সুন্দর এবং প্রভাবান্বিত হয়। এ জন্য এ সময় উঁচু আওয়াজের কিরাত নির্দিষ্ট হয়েছে।