শায়খ আবদুর রহমান আস সুমাইত।

আবদুর রহমান আস-সুমাইত। এ শতাব্দীর অন্যতম মহান ইসলাম প্রচারক ও মানবসেবক। সুমাইত পেশায় একজন চিকিৎসক। চাইলেই তিনি জন্মভূমি কুয়েতে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু উম্মাহ ও মানবতার প্রতি পরম মমত্ববোধ তাকে নিয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার প্রত্যন্ত পথে প্রান্তরে।

দ্বীন ও মানবতার সেবায় তিনি জীবনোৎসর্গ করেছিলেন। আর্ত-মানবতার কল্যাণে দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকা মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছেন। শায়খ সুমাইত তার সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আফ্রিকার মানুষদের আপন করে নিয়েছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা দেখে মানুষ দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

আফ্রিকা মহাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, অনাথদের আশ্রয় দান, যুগোপযোগী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আফ্রিকানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা ছিল— শায়খ সুমাইতের পুরো জীবনের ধ্যানজ্ঞান।

জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা

তার পুরো নাম ড. আবদুর রহমান হামুদ আস-সুমাইত। ১৫ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে কুয়েতের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সজ্জন, ধার্মিক, পরিশ্রমী ও অমায়িক ছিলেন। শৈশবেই জানতে পেরেছিলেন— আফ্রিকার মানুষের বঞ্চনা ও তিতিক্ষার কথা। ভবিষ্যতে আফ্রিকায় কাজ করবেন ভেবে— তখন থেকে তিনি দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের মতো জীবন যাপনের চেষ্টা করতেন। ইসলামের মহান নবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফদের সততা ও সাহসিকতাময় জীবন তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। এ মহামানবদের জীবনীপাঠ তার মাঝে অনাড়ম্বরতা, মানবসেবা ও কষ্টসহিষ্ণুতার গুণ এনে দিয়েছিল।

শায়খ সুমাইত তখন মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেন। এ সময় কুয়েতের রাস্তায় বিদেশি শ্রমিকদের বঞ্চনা তাকে বিমর্ষ করে তোলে। তার পরামর্শে বন্ধুরা সবাই মিলে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য একটা গাড়ি কিনে দেন। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে— তিনি ভালো মানের শিক্ষাবৃত্তি পেতেন। জরুরি খরচপাতি ছাড়া অবশিষ্ট সব— তিনি অসহায় মানুষদের দিয়ে দিতেন।

১৯৭৪ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এখানে তিনি মুসলিম শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে মানবসেবা ও ইসলাম প্রচারে নিবিষ্ট থাকেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবসেবায় ইসলাম সব ধর্ম ও মতবাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে।

কর্মজীবন ও মানবসেবায় যোগদান

কানাডার মন্ট্রিয়াল পাবলিক হাসপাতাল ও যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ হাসপাতালে কাজ করেছিলেন। ১৯৮০ সালে জন্মভূমি কুয়েতে ফিরে আসেন। কুয়েতের আল-সাবাহ হাসপাতালে যোগদানের পাশাপাশি সেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় তার মহীয়সী স্ত্রী উম্মে সুহাইব তাকে পূর্ব এশিয়ায় দ্বীন প্রচার ও মানবসেবার জন্য হিজরত করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এরই মধ্যে কুয়েতের আমির জাবির আহমদ আল-সাবাহের স্ত্রীও তাকে আফ্রিকায় গিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুরোধ জানান।

শায়খ সুমাইত সে লক্ষ্যে পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউইতে পৌঁছান। সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোর দুঃখ-যাতনা ও ঔপনিবেশিক শক্তির সৃষ্ট— দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ও মিশনারিদের দারিদ্র বিমোচনের আড়ালে ধর্মান্তরকরণ তৎপরতা এবং শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়া— ইত্যাদি বিষয় শায়খ সুমাইতের বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।

তার জন্মভূমি কুয়েত সিটি।

তিনি স্থির করেন— সারাটা জীবন আফ্রিকানদের মাঝে ইসলাম প্রচার ও মানবসেবায় কাটিয়ে দিবেন। সেই থেকে মৃত্যু অবধি তিনি আফ্রিকায়ই ছিলেন। মিশনারি প্রভাবিত বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়াও বারবার মোজাম্বিক, কেনিয়া ও মালাউইর প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিজগিজ করা বিষধর কোবরা সাপের মুখোমুখি হয়েও অলৌকিকভাবে ফিরে আসেন তিনি।

যেসব দেশে যেসব কাজ করে তার সংস্থা

শায়খ সুমাইত দেখতে পেয়েছিলেন তাঞ্জানিয়া, মালাউই, দক্ষিণ সুদান, মাদাগাস্কার, কেনিয়া, নাইজার এর মতো দেশগুলোয় শুধুমাত্র এক মুঠো খাবারের জন্য বিশাল সংখ্যক মুসলমান ধর্মান্তরিত হয়ে পড়েছে । যারা তখনও মুসলমান তারাও ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে পর্যন্ত ধারণা রাখে না। এসব মুসলমানকে পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন তিনি।

১৯৮১ সালে তিনি আল-আউনুল মুবাশির বা ডাইরেক্ট এইড নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সব আফ্রিকানের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটি এখন পর্যন্ত আফ্রিকার সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থা। আফ্রিকার ২৯টি দেশে সংস্থাটি কার্যক্রম পরিচালনা করে। আফ্রিকানদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান সহজলভ্য করার জন্য কাজ হরদম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই সংস্থা।

আফ্রিকায় দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সংস্থাটি ১৬ হাজার ৪৯৫টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে চারটি মহাবিদ্যালয়, বহু সংখ্যক রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল, প্রকাশনা সংস্থা, নয় হাজার গভীর নলকূপ, ১২৪টি হাসপাতাল, ২১৪টি নারী স্বাবলম্বীকরণ কেন্দ্র, ২ হাজার ২০০ মসজিদ, বহু মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দাওয়াহ ও রিসার্চ সেন্টার প্রভৃতি। সংস্থাটি এ পর্যন্ত দশ হাজার এতিম শিশুর লালন পালন করেছে। এছাড়াও শায়খ সুমাইতের সম্পাদনায় যাত্রা শুরু করা অভিজাত ম্যাগাজিন আল-কাওসার আফ্রিকার দুঃখ-বেদনা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে।

এক কোটি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে

শায়খ সুমাইত মনে করতেন, শুধুমাত্র আরবের ধনাঢ্য মুসলমানরা যথাযথভাবে জাকাত দিলেও পুরো মুসলিম বিশ্বকে দারিদ্র্য মুক্ত করা সম্ভব। কারণ, এর পরিমাণ কোনোভাবেই ৫৬ হাজার ৮৭৫ বিলিয়নের কম হবে না— যা পঁচিশ কোটি দরিদ্র মুসলমানের স্বাবলম্বী হওয়ার মৌলিক পুঁজি হিসেবে যথেষ্ট।

শায়খ সুমাইত দাওয়াহ ও দাতব্য কাজে তার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে গেছেন ডজনখানেক বইতে। তোমার সকাশে আফ্রিকা, আফ্রিকায় কল্যাণের সফর, ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার কিছু চিত্র… একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা, মাদাগাস্কারের এন্তিমারো উপজাতি, আফ্রিকার কান্না এমনই কিছু বই। এছাড়াও পত্র পত্রিকায় তার অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।

শায়খ সুমাইত (রহ.) ডাইরেক্ট এইড ছাড়াও আরো ডজনখানেক দাতব্য সংস্থার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আফ্রিকার মানুষরা তার সততা, নিষ্ঠা ও সুন্দর চরিত্রে বিমোহিত হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। কুয়েতের আল-কাবাস পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সুমাইতের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা ডাইরেক্ট এইডের মাধ্যমে ১০ মিলিয়ন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে।

যেসব পুরস্কারে ভূষিত শায়খ সুমাইত

১৯৯৬ সালে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে অনন্য অবদানের জন্য শায়খ সুমাইত বাদশা ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারটির অর্থমূল্য সাড়ে সাত লক্ষ সৌদি রিয়াল পুরোটাই তিনি আফ্রিকার জন্য ওয়াকফ করে দেন। ২০১০ সালে তিনি দাতব্য কাজের জন্য শারজার ফারেস পদক লাভ করেন।

একই বছর তিনি কাতার ফাউন্ডেশন ও দুবাইয়ের পক্ষ থেকে মানবসেবা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও বেনিনের রাষ্ট্রপতি পদক, কুয়েতের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক, সুদান, আজমান ও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। ২০০৩ সালে সুদানের বিখ্যাত উম্মে দারমান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে গিয়ে— শেষ জীবনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে শেষবার তিনি আফ্রিকার কথাই জিজ্ঞেস করেছিলেন— আশপাশের মানুষদের। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট তিনি নশ্বর এ দুনিয়া ছেড়ে যান। তত দিনে দাতব্য কার্যক্রমের প্রয়াস বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে।

আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের সাবেক পরিচালক খনফার ওয়াদ্দাহ তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘আফ্রিকায় আমি ১১টি বছর কাটিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি— সবাইকে দেখেছি, শায়খ সুমাইতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে।’

শায়খ সুমাইতের কীর্তিময় জীবন যুগ-যুগান্তরে পৃথিবীর সব মানবসেবীকে নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করে যাবে।

-আল-জাজিরা এনসাইক্লোপিডিয়ায় ‘আবদুর রহমান সুমাইত; তাবিবুন আলাজাল ফাকরা ফি আফ্রিকা— শিরোনামে প্রকাশিত লেখা অবলম্বনে।

হাবিবুল্লাহ বাহার। তরুণ আলেম, লেখক ও অনুবাদক