প্রতীকী ছবি

জীবনে মায়ের বিকল্প নেই। মায়ের পায়ের নিচে দেওয়া হয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের যে কষ্ট ও বিপন্ন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তার পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করা হয়েছে মাতৃত্বের এ মর্যাদা; হিরকখণ্ডের চেয়ে দামি বানানো হয়েছে তাদের। মা সন্তানের জন্য সীমাহীন কষ্ট করেন, তাই তো মহান আল্লাহ তার সঙ্গে সদাচরণ করার কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। 

আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবা সম্পর্কে জোর নির্দেশ দিয়েছি, কেননা তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সয়ে পেটে বহন করেছেন আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা লুকমান, আয়াত : ১৪)

গর্ভে সন্তান আসা নারীর জন্য বোঝা নয়, বরং সম্মান ও সৌভাগ্যের। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত— তিনি বলেন, নবীজি (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিমের দুধমাতা সালামাকে (রা.) নবীজি (সা.) বলেছিলেন, তোমরা নারীরা কি এতে খুশি নও যে, যখন কোনো নারী তার স্বামীর পক্ষ থেকে গর্ভধারিণী হয় আর স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তখন সে আল্লাহর জন্য সর্বদা রোজা পালনকারী ও সারা রাত নফল ইবাদতকারীর মতো সওয়াব পেতে থাকবে? তার যখন প্রসব ব্যথা শুরু হয় তখন তার জন্য নয়ন জুড়ানো কী কী নেয়ামত লুকিয়ে রাখা হয়, তা আসমান-জমিনের কোনো অধিবাসীই জানে না। সে যখন সন্তান প্রসব করে তখন তার দুধের প্রতিটি ফোঁটার বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হয়। এ সন্তান যদি কোনো রাতে তাকে জাগিয়ে রাখে (কান্নাকাটি করে মাকে বিরক্ত করে ঘুমুতে না দেয়) তা হলে সে আল্লাহর জন্য নিখুঁত সত্তরটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব পাবে।’ (তাবরানি, হাদিস : ৬৯০৮; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৪/৩০৫)

গর্ভাবস্থায় কোনো নারী মারা গেলে তার জন্য রাসুল (সা.) শহীদ হওয়ার সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত (শহীদ) হওয়া ছাড়াও আরও সাত ধরনের শহীদ আছে— ১. মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ২. পানিতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৩. পক্ষাঘাতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৪. পেটের রোগের কারণে (কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদিতে) মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৫. অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৬. কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ এবং ৭. যে মহিলা গর্ভাবস্থায় মারা যাবে সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ : ৩১১১)

আরও পড়ুন : যে ৪ আমলে নারীরা সহজেই জান্নাতে যাবে

গর্ভাবস্থায় একজন নারীর পূর্ণ মনোযোগ থাকে অনাগত বাচ্চাকে কেন্দ্র করে। তার আগমনের খুশিতে মা সব রকমের কষ্ট সহ্য করেন। ইসলাম যেহেতু একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এ জন্য এতে রয়েছে মানবজীবনের সব কিছুর নির্দেশনা। কোরআন ও হাদিসে একজন গর্ভবতী মায়ের পরিপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করলে শুধু কষ্ট সহ্য করতে পারবে এমন নয়; বরং এর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার আত্মিক তারবিয়াতের প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া সহজতর হবে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের কর্তব্য অনাগত সন্তানের জন্য কল্যাণের দোয়া করা। গর্ভাবস্থায় হজরত মারিয়াম (আ.)-এর মায়ের আমল থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। মারিয়াম (আ.)-এর জন্মের পূর্বে যখন তার গর্ভধারিণী মাকে সন্তানের ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হলো, তখন তিনি মহান প্রভুর দরবারে যে দোয়াটি করেছিলেন সেটি সুরা আলে ইমরানের ৩৫ নাম্বার আয়াতে বিদ্যমান। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইমরানের স্ত্রী যখন বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।’ মারিয়াম (আ.)-এর মায়ের এ দোয়ার মাহাত্ম্য জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এ দোয়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে মারিয়াম (আ.)-এর মতো এমন রত্মগর্ভা কন্যা সন্তান দিয়েছেন যিনি পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছেন নবী ঈসাকে (আ.)। এ জন্য গর্ভবতী মায়েদের উচিত এ দোয়াটি গুরুত্বসহকারে পড়া যেন আল্লাহ তায়ালা তাকেও নেককার পরহেজগার সুসন্তান দান করেন। বাচ্চার সুস্থতা ও নেক হওয়ার জন্য এ দোয়াটিও পড়তে পারেনÑ ‘রাব্বি হাবলি মিনলাদুনকা জুররিয়াতান তাইয়িবাতান ইন্নাকা সামিউদ্দুয়া’, অর্থাৎ, ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৮)

আরও পড়ুন : নারীরা মাথার চুল কাটতে পারবে কি?

নেক নিয়তে পুত্র সন্তানের জন্য পড়া যেতে পারে, ‘রাব্বি হাবলি মিনাস সালিহিন’, অর্থাৎ, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান করুন।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০০)

গর্ভাবস্থার সুসংবাদ সীমিত কিছু মানুষকে শোনানো। বেশি মানুষের মাঝে আলোচিত হওয়া ঠিক নয়। অবশ্য ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সবাইকে জানাতে বাধা নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিছু খুশির সংবাদ গোপন রাখতে হয়। কেননা প্রত্যেক সংবাদ শ্রবণকারী বন্ধু হয় না।’ (তাবরানি)

হাদিসটির উদ্দেশ্য হলো হিংসা ও বদ নজরের প্রভাব মানুষের ওপর পড়ে। আর যে নিষ্পাপ শিশুটি আগত তাকে বদ নজর থেকে হেফাজতে রাখা একজন মায়ের দায়িত্ব। তাই মায়ের জন্য উচিত গর্ভের সংবাদ শুধু তাদেরই দেওয়া যারা তাতে খুশি হবে। কোনোরূপ খারাপ ধারণা পোষণ করবে না। পাশাপাশি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা, যাতে আল্লাহর এই কৃতজ্ঞতা আদায়ের প্রভাব আগত বাচ্চার মধ্যেও স্থানান্তরিত হয়। নিয়তও খালেস রাখা চাই।

আরও পড়ুন : নারীরা পরপুরুষের সামনে নামাজ পড়তে পারবেন?

একজন সত্যিকার মুসলিম নারী গর্ভধারণের সময়টাকে বিপদ-মুসিবত মনে করে না; বরং এ কষ্ট-যাতনাকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। এ সময়টাতে নারী আল্লাহর বিশেষ রহমতে ডুবে থাকে। এ সময়ের ইবাদত অন্য সময়ের ইবাদতের চেয়ে অনেক দামি ও মূল্যবান। এ জন্য সব সময় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা। নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। যত বেশি সম্ভব কোরআন তেলাওয়াত করা। সব সময় পবিত্র থাকা। অজু সহকারে থাকা। এগুলো শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিরও কারণ হবে।

এছাড়াও মা হতে যাওয়া নারীকে ধৈর্য ও অল্পেতুষ্টির পরিচয় দিতে হবে। যেসব খারাপ অভ্যাস মানুষের জীবনকে নিকৃষ্ট বানিয়ে ফেলে যেমন হিংসা-বিদ্বেষ, অহঙ্কার, আত্মগরিমা ও মিথ্যা এসব থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। অনর্থক অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিহার করা। অত্যধিক প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া। সব সময় ইবাদতে জড়িয়ে থাকা। এসব কাজে পেটে ধারণ করা অনাগত সন্তানও অংশগ্রহণ করে আর আল্লাহর সামনে মায়ের প্রত্যেকটা আমলের সাক্ষীও হবে সে।