দুবাইয়ে আছি প্রায় সপ্তাহ তিনেকের মতো। যেখানেই যাচ্ছি, যা কিছু দেখছি; মনে হচ্ছে সবকিছুই যেন করা করা হয়েছে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে। ভিনদেশী কেউ বেড়াতে এসে যেন কোন সমস্যায় না পড়েন, সময়টা আজীবন মনে রাখার মতো হয়; সে জন্য চেষ্টার কোন কমতি নেই। মসজিদ থেকে দোকান-যেখানেই যাবেন ঘুরে দেখে মুগ্ধ হবেনই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমি যেখানে উঠেছি তার ঠিক পাশেই পৃথিবীর বিখ্যাত স্বর্ণের মার্কেট। হেঁটে গেলে চোখ ধাধিয়ে যায়! স্বর্ণ আর হীরার আলোয় চারপাশ কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

স্থানীয়রা বলেন, গোল্ড স্যুক। স্যুক আরবি শব্দ, মানে দোকান। এই মার্কেটে ঢুকতে গিয়েই চোখে পড়বে বড় একটা তোরন। যেখানে লেখা দুবাই সিটি অব গোল্ড! ঠিক তাই, সোনার রাজ্যেই যেন পা রেখেছি। বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকানের দরজা ঠেলে ঢোকার প্রয়োজন নেই, বাইরে থেকেই দেখা মিলছে নানা ডিজাইনে নেকলেস, চেইন, ব্রেসলেট, রিং, সঙ্গে সোনার বার তো রয়েছে!

ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন সেই পুরোনো রাজা-বাদশাহদের ভোগ বিলাসের জীবনে যেন পা রেখেছেন। দোকানি আরব থেকে শুরু করে ভারত, বাংলাদেশের সবাইকে পেয়ে যাবেন। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ গেলে ভরি-আনা এমন হিসাব নিয়ে কিছুটা তো ঝামেলা হতেই পারে। 

যেভাবে দুবাই হয়ে উঠল স্বর্ণের বাজার

আজ দুবাই নাম বললেই যেমন খাঁটি স্বর্ণের সোনালী রঙটা ভেসে উঠে, সেটা কিন্তু একদিনে হয়নি। একদিনে এতোটা বিশ্বস্ত হয়েও উঠা যায় না। একজন ক্রেতা দুবাইয়ে আজ যে চোখ বন্ধ করেই এখান থেকে স্বর্ণ কিনে জিতে যান, তার পথটা অনেক দীর্ঘ আর সততায় পূর্ণ।

ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু বুঝলাম, দুবাইয়ে স্বর্ণের বাজার শুরু হয়েছে সেই ১৯৫৮ সালের দিকে। তখন সবে জেগে উঠতে শুরু করেছে এই জনপদ। এতসব অট্টালিকা তো আর উন্নয়নও ছিল না তেমন। মরুভূমির তপ্ত বালিতে আরব বেদুঈনরা ঘুরে বেড়িয়ে ব্যবসা খুঁজতেন। এরমধ্যে সিরিয়ার দামেস্ক থেকে একদল আরব ব্যবসা করতে আসেন দুবাইয়ে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসেন মান সম্পন্ন কিছু মনি-মুক্তা। ব্যস, এখানে ক্রেতাও মিলে গেল বেশ! জনপ্রিয় হলো এই ব্যবসা। 

তারপর থেকে স্বর্ণ ও বানানো গহনা বিক্রি হতে থাকল। ব্যস, ধীরে ধীরে একটু একটু করে বড় হতে থাকল এই ব্যবসা। তবে কোনভাবেই সেটিতে প্রতারণা কিংবা অসততা ছিল না। এখানে তেমনটা নেই। খাটি স্বর্ণ মিলবে, সুলভ দামে। সময়ের পথ ধরে এভাবেই এক সময় এই দেরা দুবাই হয়ে উঠল গোটা বিশ্বে স্বর্ণের রাজধানী। এখন তো মরুর এই দামে কোন পর্যটক আসলেই নিশ্চিত পা পড়বে গোল্ড স্যকে। স্বর্ণ কেনার চেয়ে দেখাতেও কম সুখ নেই!

বড় হচ্ছে স্বর্ণের বাজার

দেরা দুবাইয়ে এই স্বর্ণের মার্কেটটিতে এখন প্রায় চারশর মতো দোকান রয়েছে। বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডই এখানে হাজির। বাজার বড় হওয়ায় পরিকল্পনাটাও বড় হয়েছে আমিরাত সরকারের। এখন এই দোকান ঘিরে একটা পর্যটন স্পট করার পরিকল্পনাও আছে তাদের মাথায়। পাশের ক্রিক নদীর পার ধরে গড়ে উঠছে আরেকটি মার্কেট। প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, এখানে এই ব্যবসার। সময়ের সঙ্গে পথ চলে তার প্রসারও হয়েছে। তবে এবার শুধু স্বর্ণ, হীরা কিংবা মনি-মুক্তো বিক্রি নয়-এই ব্যবসাটাকে ঘিরে বড় পরিকল্পনা করা হয়েছে। পর্যটকরা যেন ঘুরতে আসেন, সেসব কথা মাথায় রেখে নানা উদ্যোগ চোখে পড়ছে আশপাশে।

এখানে পরিবেশটা আরও সুন্দর করতে স্থানীয় মাছ বাজার উঠিয়ে কিছুটা দূরে নেওয়া হয়েছে। আর লোকেশনটাও দুর্দান্ত। মেট্রো-বাস যে কোন কিছুতেই আসার ব্যবস্থা আছে। এখানে আসার সময় ব্যক্তিগত গাড়ি নেওয়াটাকে নিরুৎসাহী করা হয়। কারণ একটাই পাকিং ঝামেলা। শুক্রবার ও অন্য রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন ছাড়া সকাল দশটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে দুবাই গোল্ড স্যক। তবে কিছু দোকান দুপুর একটা থেকে বন্ধ থাকে বিকাল চারটা অবধি।

বাহারি রঙের অলঙ্কার

গোল্ড স্যকে পা রাখলে সময় যে কখন ফুরিয়ে যাবে টেরই পাবেন না। মুগ্ধ হয়ে নানা ডিজাইনে অলঙ্কার দেখতে দেখতেই বেলা পেরিয়ে যায়। এখানে ১৮ ক্যারেট থেকে শুরু করে ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণের দেখা মেলে। তবে জনপ্রিয়তায় ২২ ক্যারেট এগিয়ে। পণ্যের ডিজাইনেও আছে আধুনিক আর আরব ঐতিহ্যের ছোঁয়া। 

শুধু স্বর্ণ নয়, দেরা দুবাইয়ের এই সোনার দোকানে কেনা যায় অনেক কিছু। রয়েছে ডায়মন্ড। মহামূল্যবান পান্না, রুবি, অ্যামিথিস, সিল্কসহ কতো কী। আবার রূপা, এনামেল, প্ল্যাটিনামও পেয়ে যাবেন। চাইলে স্বর্ণের বারও কিনে নিতে পারেন যে কেউ। তবে একজন সাধারণ ক্রেতা বিশেষ করে বাংলাদেশের, তারা ট্যাক্স ফ্রি হিসেবে ১০ ভরির মতো স্বর্ণ সঙ্গে নিতে পারে। 

কেন স্বর্ণ কিনতে সবাই দুবাই আসে?

যেদিন বিশ্বকাপ কাভার করতে ঢাকা ছাড়বো, ইউএস বাংলার বিমানে আমার ঠিক পাশেই বসেছিলেন একজন যাত্রী। তার সঙ্গে কথা হতেই তিনি জানালেন স্বর্ণের ব্যবসা করেন। নিয়মিতই তার গন্তব্য থাকে দুবাই। এখানে পা রেখেও বুঝতে পারছি-গোটা বিশ্বেরই স্বর্ণের প্রধান গন্তব্য এই দুবাই। কেন সবাই এই মরুর বুকে আসে সোনা কিনতে?

প্রশ্নটা রেখেছিলাম গোল্ড স্যকের একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে। তিনি আছেন স্কাই জুয়েলার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। বিদিত কুমার  বলছিলেন, ‘দেখুন, এখানে সবাই সোনা-রুপা কিংবা হীরা কিনতে আসে কারণ একটাই সততা। এখানে মাপ আর স্বর্ণের মান দুটোতে কোন ছাড় নেই। একমদম সঠিক সবকিছু। আর দামটাও অন্য দেশের তুলনায় কম। এখান থেকে স্বর্ণ কিনে কেউ ঠকেছে এমন ইতিহাস নেই। এ কারণেই অলঙ্কার পিপাসীরা এখানে ছুটে আসেন।’

অবশ্য মাঝে করোনার কারণে বেশ বিপাকে ছিলেন ব্যবসায়ীরা। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বিদিত কুমার বলছিলেন,  ‘মাঝে অনেকটা সময বেশ বিপাকে ছিলাম আমরা। দোকানের কর্মচারীরাও ছিলেন চাপে। এখন অবশ্র পাল্টে যাচ্ছে। ফ্লাইট চালু হয়েছে। আমাদের ক্রেতাও বাড়ছে।’ বাংলাদেশি পেয়ে স্বর্ণ কেনার একটা টেকনিকও জানিয়ে দিলেন আমিরাত প্রবাসী চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী, ‘এখানে স্বর্ণের দাম প্রতিদিনই উঠা নামা করে। এই যেমন আজ আগের দিনের চেয়ে ২০০ দিরহাম বেড়ে গেছে। এ কারণেই কেনার আগে সতর্ক থাকতে হবে। হাতে সময় থাকলে অপেক্ষা করবেন। বাজার বুঝে তবে কিনবেন।’

কথা মন্দ বলেননি বুঝে-শুনে তবেই কিনতে হয় স্বর্ণ। কিন্তু এটা চ্যালেঞ্জ দিয়েই এখানকার ব্যবসায়ীরা বলে থাকেন, সততা রেখেই পণ্য বিক্রি করেন তারা। আর গুণমান এদিক-সেদিক হলে ব্যবসাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ কঠোর নজরদারিতে থাকেন তারা।

৫৮ কেজি ওজনের স্বর্ণের আংটি!

ভুল শুনেননি, দুবাইয়ের স্বর্ণের বাজার এতোটাই বড় যে এক গবেষণায় দেখা গেছে এখানে বছরে প্রায় ১০০ টন স্বর্ণ বিক্রি হয়। সবার তো জানা আছেই ১০০০ কেজিতে কিন্তু একটন! এবার বুঝুন কতোটা বড় এখানকার বাজার। সেই সত্যতা যাচাইয়ের চেয়ে নিজ চোখে বিস্ময়কর একটা সোনার রিং দেখতে চাইলে যেতে পারেন গোল্ড স্যকে। গিনেজ বুকে নাম উঠা এক আংটির দেখা মিলবে এখানে।

বিশ্বের সবচেয়ে ওজনদার আংটি রয়েছে গোল্ড স্যকে। নাজমাত তাইবা বা স্টার অফ তাইবার বাড়ি নামের সেই দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। সবার চোখ ৬৩ কেজি ওজনের দামী পাথর আর সোনায় মোড়ানো সেই আংটিতে। এটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫৮ জেরি বেশি স্বর্ণ। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত, সৌদি আরবের তাইবা গোল্ড অ্যান্ড জুয়েলারি দ্বারা তৈরি আংটিটি গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে। এখনকার বাজারে এটির মূল্য ২.২ মিলিয়ন দিরহামের বেশি। এটি অবশ্য বিক্রয়ের জন্য নয়। তবে এই ডিজাইনের ছোট্ট কপি বিক্রি করে দোকানটি। স্যুভিনির মতো বিক্রিও হচ্ছে দেদার!

মজার ব্যাপার হলো-আরও অনেক ব্যতিক্রম আর বিলাসী স্বর্ণের অলঙ্কার আর পণ্য চোখে পড়ল এখানে। স্বর্ণের স্যুইমসুট, মানে সোনায় তৈরি সাতারের পোশাক, নাইটগাউন, অন্তর্বাস, এমন কী চেয়ার-টেবিল, দরজা, ট্যাপ আর টয়লেটও চোখে পড়ল। দেখা মিলল কেজি ছাড়ানো স্বর্ণের বালা, নেকল্যাসসহ কতো কী। এগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, বিক্রিও হচ্ছে! আমাদের কাছে বিস্ময় মনে হলেও অনেকের কাছে এই বিলাসিতাই এমন অভিনব স্বর্ণের পণ্যের জন্ম দিচ্ছে সোনার দোকানে!

কিনতে গিয়ে যে কথা মাথায় রাখবেন

দুবাই মার্কেটে স্বর্ণ কেনা যেমন কঠিন না, আবার সহজও নয়। ভারতীয় একটি দোকানের কর্মচারীরর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বাসির উদ্দিন নামের সেই দোকানি শিখিয়ে দিলেন কিছু টিপস, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে কেউ গেলে তো আর পকেট ভর্তি ডলার-দিরহাম নিয়ে যায় না।

বাসির বলছিলেন, ‘দেখুন, সবচেয়ে বড় দোকানটায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গোল্ড স্যকে আশপাশে অনেক ছোট দোকান আছে সেটিতে প্রবেশ করুন। তারপর নিজের পছন্দের অলঙ্কার খুঁজে নিন। সেখানে আপনি যেমন সমাদর পাবেন তেমনি পণ্যতেও কিছু দিরহাম কম পাবেন। আর দামাদামি করুণ। লজ্জা পাবেন না। কথা বললে হয়তো কিছু কমাতেও পারেন সেই দোকানের মালিক। আর ক্যারেট মাথায় রাখবেন। ১৮ থেকে ২৪ ক্যারেট মিলবে এখানে। আপনার যেটা প্রয়োজন সেটি নেবেন।’

জানিয়ে রাখলেন, সোনা কেনার সবচেয়ে ভাল সময় সকাল ১১টার দিকে। এরপর দিনের আলো বাড়তে থাকলে অনেক সময় দামটাও বাড়তে থাকে। বাসিরের কাছেই জানলাম, এখানে আরবরা এই ব্যবসা করছেন পরম্পরায়। অনেকটা বাংলাদেশেরই মতো। বাপ-দাদারা করতেন, এখন ছেলেরা এই স্বর্ণ ব্যবসার হাল ধরেছে।

শখের বশেও অনেকে ধরে রেখেছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সোনার দোকান। পৃথিবীর সেরা গল্পগুলো এভাবেই সমৃদ্ধ হয়েছে। সততায় পরম্পরায় পথ চলে এগিয়ে যাচ্ছে দুবাই। সোনার উজ্জ্বল্য ছড়ানো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, শুধু লাভের আশায় ব্যবসা করলেই হয় না-থাকতে হয় এমন সততা, অর্জন করতে হয় একটু একটু করে বিশ্বস্ততা। তবেই তো মাথা তুলে দাঁড়ায় একটা জাতি!

এটি/এমএইচ