মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা। বাবা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানান। তিনিই সাহায্য করেছেন ক্রিকেটে। বাড়ির ছাদে তাদের সিমেন্টের একটা পিচ ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল ছুঁড়ে মারতেন বাবা বিবেক বাদোনি। ছাদের চারপাশে পাথর সাজিয়ে রাখতেন ফিল্ডার হিসেবে। ছেলে আয়ুশকে বলতেন গ্যাপে মারতে। এভাবেই শুরু ক্রিকেটের ।  

কোচ তারেক সিনহার অধীনে বেড়ে উঠেন একটু একটু করে। ভর্তি হন সনেট ক্লাবে। শোনা যায় দিল্লির ক্রিকেটে ক্লাবটির প্রভাব অনেক। সুযোগ পাওয়া নাকি সহজ। কিন্তু আয়ুশের ক্ষেত্রে হয়নি সেটি। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। সোমবার যখন সুযোগটা পেলেন, আয়ুশ মিস করেন কী করে!

‘তুমি আমার খুঁজে বের করা প্রতিভাগুলোর যত্ম নিতে পারো না’ মজা করেই আতুল ওয়াসেনকে কথাটা বলেছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। এরপর পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘এই ছেলেগুলোর দিকে নজর দেও।’ দ্রাবিড়ের বলা ছেলের সংখ্যা ছিল তিনজন, তাদের একজন আয়ুশ বাদোনি। গতকাল রাতে লখনউ সুপার জায়ান্টের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন তিনি।

দ্রাবিড়ের মজা করে বলা কথাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিলেন দিল্লি জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েসান। নির্বাচকদের বৈঠকে বাদোনিকে দলে নিতে বললেন তিনি। কিন্তু তার কথা শোনা হলো না। তারা বেছে নিলো উন্মুক্ত চাঁদকে। এরপর কী হলো? ‘আমি মিটিং থেকে বেড়িয়ে চলে আসলাম। চেয়ারম্যান হিসেবে আমি জোর করতে পারতাম, কিন্তু না করার সিদ্ধান্ত নেই।’

ক্ষুব্ধ ওয়েসান এরপর মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ট্রায়ালে পাঠালেন বাদোনিকে। স্কাউট কিরাণ মোরেকে বললেন, ‘এই ছেলেটাকে দেখো।’ বাদোনি সেবার একটা ম্যাচেও খেলতে পারেননি দিল্লির হয়ে। ৩০ জনের দলে থাকলেও জায়গা পাননি চূড়ান্ত স্কোয়াডে। এ বছরও সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে খেলেছে পাঁচ ম্যাচ, চারটিতে ব্যাটিংয়ের সুযোগই পাননি। যেই ম্যাচটিতে পেয়েছিলেন, করেছেন কেবল ৮ রান।

দিল্লি ক্রিকেটে বলা হয়, আয়ুশের হাতে প্রতি বলের জন্য তিনটা শট আছে। সোমবার রাতে তার প্রদর্শনীরই দেখা মিলল যেন। চারটা চার মেরেছেন, তিনটা ছক্কা। রানগুলো এসেছে এমন সময়, লখনউ যখন ২৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে। শেষ পর্যন্ত তার দল জিততে পারেনি, এই আলাপটা নিশ্চয়ই ভিন্ন।

অন্তত ওয়েসানের কাছে আয়ুশের পারফরম্যান্সটাই মুখ্য, ‘আমি খুশি সে নিজের সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। আয়ুশ খুবই সাহসী ক্রিকেটার। আমি আশা করি সে সাফল্যের পেছনে ছুঁটা বন্ধ করবে না। তার ভারতের হয়ে খেলার লক্ষ্য ঠিক করা উচিত।’

২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এশিয়া কাপে খেলেছিলেন। ওই সময়ই নজরে পড়েন দ্রাবিড়ের। যদিও জায়গা হয়নি নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে। এরপর অনেকটা নিভৃতেই কেটেছে সময়। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে স্পিনটার জন্যই বোধ হয়, তাকে ২০ লাখ রুপিতে দলে নিয়েছিল লখনউ। এখন নিশ্চয়ই তারাও নিজেদের ভীষণ ভাগ্যবান ভাবছে! 

অন্তত অধিনায়ক লোকেশ রাহুলের জন্য তো তিনি বিশেষ কিছুই। লখনউয়ের ক্যাম্পে তিনি আয়ুশের নাম দিয়েছেন ‘বেবি এবি ডি ভিলিয়ার্স।’ দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবদন্তির সঙ্গে আয়ুশের শট রেঞ্জের মিল খুঁজে পান লখনউ অধিনায়ক। জাতীয় দলে খেলে ফেলা ক্রুনালকে ছাপিয়ে তাই তিনি দলের বিপর্যয়ে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন আয়ুশকে।

গুজরাট ম্যাচের পর তাই তার উচ্ছ্বাস ছিল এমন, ‘সে বেবি এবি। ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন থেকেই সে বিস্ময়কর ছিল। একজন বাচ্চা ছেলে হয়েও, ৩৬০ ডিগ্রিতে খেলতে পারে। সুযোগটা কাজে লাগানোয় ওর জন্য আমি অনেক খুশি। চার ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর ক্রিজে যাওয়া তার জন্য আদর্শ না কিন্তু চাপের মধ্যেও আয়ুশ ভালো করেছে। আশা করি সে এটা করে যাবে।’

অধিনায়কে উচ্ছ্বসিত হলেও আয়ুশের জন্য আগের রাতটা ছিল রোমাঞ্চের, শঙ্কারও। সারারাত ঘুমাতে পারেননি। পরে অবশ্য এসে করে ফেলেছেন ৫৪ রান। অনুশীলন ম্যাচে এমন দুটি ফিফটিই তার জায়গা নিশ্চিত করেছিল একাদশে।

সুযোগটা অবশ্য তাকে এনে দিয়েছেন লখনউয়ের মেন্টর গৌতম গম্ভীর। আইপিএলে দল পাওয়াও তার কারণেই। গুজরাটের বিপক্ষে ম্যাচশেষেও তাই আয়ুশ ভুললেন না গম্ভীরকে, ‘আমি দিল্লির হয়ে খুব বেশি সুযোগ পাইনি। গৌতম ভাইয়া, আমাকে অনেক সমর্থন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সাধারণ ক্রিকেট খেলতে। উনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন এক ম্যাচ পরই বাদ দেওয়া হবে না। তার সমর্থন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’

মানুষের জীবনে রঙ বদলে যাওয়ার গল্প শোনা যায় প্রায়ই। প্রকাশ্যে, খেলার দুনিয়ায় সেটা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি পারে এখন আইপিএল। সেলাই করা জুতা পরে ক্রিকেট খেলা নটরাজান কিংবা আয়ুশ; বারবার তো প্রমাণ করেন সেটিই!

এমএইচ/এটি