অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্বের এক দ্বীপরাষ্ট্রের নাম পাপুয়া নিউগিনি। প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশটির যেমন রয়েছে মন মাতানো সৌন্দর্য, তেমনি মাটির নিচে রয়েছে অজস্র খনিজ সম্পদ। এতকিছু থাকার পরও অবশ্য বেশ বিপর্যস্ত দেশটির অর্থনীতি। প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। তবে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বিশ্ব ক্রিকেটে ঠিকই হাঁটি হাঁটি করে এগিয়ে চলেছে নবীন এই ক্রিকেট খেলুড়ে দেশটি। এবার ইতিহাস গড়ে জায়গা করে নিয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও।

কোন মেজর আইসিসি টুর্নামেন্টে এর আগে কখনোই অংশ নেয়নি পাপুয়া নিউগিনি পুরুষ ক্রিকেট দল। ওয়ানডে, টি টোয়েন্টি বা টেস্ট কোন ফরম্যাটের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাতেই এতদিন অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি দলটি। ২০২১ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে এই প্রথম কোন বড় মঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে পাপুয়া নিউগিনির।

অস্ট্রেলিয়ার দখলে থাকা দ্বীপরাষ্ট্রটি ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও ক্রিকেটের বিকাশ ঘটেছে এর অনেক পরে। খ্রিষ্টান মিশনারিরা ১৯৯০ সালে খেলাটির প্রচলন করেন দেশটিতে। তবে পাপুয়া নিউগিনিতে ক্রিকেটের যাত্রা আসলে শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। এর এক বছর পরই তারা লাভ করে আইসিসির সহযোগী সদস্যের মর্যাদা।

১৯৭৩ সালে সদস্যপদ লাভ করলেও ২০১২ এর আগে আলোর মুখ দেখেনি দেশটির ক্রিকেট। বৈশ্বিক সকল টুর্নামেন্টেরই বাছাই পর্ব খেলে আসছে তারা ওই সময় থেকে। অল্পের জন্য তারা হারিয়েছে ২০১৬ সালে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের সুযোগ। 

যুব পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সাফল্য পেয়েছে দেশটি। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আটবার তারা অংশ নিয়েছে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে।

পাপুয়া নিউগিনি নারী ক্রিকেট দলও খুব একটা পিছিয়ে নেই তাদের পুরুষ দলের চেয়ে। আগামী বছরের নারী টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা পেতে মাত্র একটি ম্যাচ দূরে ছিল তারা। যদিও বাংলাদেশের কাছে হেরে শেষ হয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। তবে যুব পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সাফল্য পেয়েছে দেশটি। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আটবার তারা অংশ নিয়েছে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে।

‘অপ্রত্যাশিত ঘটনার দেশ’ বলে খ্যাত পাপুয়া নিউগিনির ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন ২০১৪ সালে ওডিআই স্ট্যাটাস প্রাপ্তি। নিজেদের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে হংকংকে হারিয়ে প্রথম ওয়ানডেতে জয় পাওয়া ছয়টি দলের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে তারা। তবে সাম্পতিক ওডিআই ফর্মের বিবেচনায় এই বিশ্বকাপে তাদের জায়গা করে নেওয়াটা অবাক করতে পারে অনেককেই। সর্বশেষ আটটি ম্যাচের সবকয়টিতেই হেরেছে তারা। 

আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাপুয়া নিউগিনির জার্সি।

তবে ক্রিকেটে অংশগ্রহণ এখনো আশানুরূপ পর্যায়ে পৌঁছেনি পাপুয়া নিউগিনিতে। জাতীয় দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় অধিষ্ঠিত আছেন মাঠ কর্মী ও কোচিং অফিসারসহ বিভিন্ন পদে। তারা একত্রে কাজ করে চলেছেন দেশটিতে ক্রিকেটকে আরো জনপ্রিয় করতে ও ক্রিকেটারদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে।

আরও পড়ুন : স্কটল্যান্ড : উপত্যকার ক্রিকেট আবারও বিশ্বমঞ্চে

বর্তমানে পাপুয়া নিউগিনিতে অনেক ক্রিকেটার আছেন যাদের পূর্বপুরুষরাও ছিলেন একই পেশার সঙ্গে জড়িত। ১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ স্কোয়াডের সদস্য চার্লস আমিনির আগমন তেমনই এক ক্রিকেট পরিবার থেকে। তার বাবা, মা এবং দাদা প্রত্যেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলকে। দেশটির ক্রিকেটে তাদের পরিবারের এমন অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পাপুয়া নিউগিনির প্রধান ক্রিকেট ভেন্যুর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমিনি পার্ক’।

চার্লস আমিনির আগমন তেমনই এক ক্রিকেট পরিবার থেকে। তার বাবা, মা এবং দাদা প্রত্যেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলকে। দেশটির ক্রিকেটে তাদের পরিবারের এমন অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পাপুয়া নিউগিনির প্রধান ক্রিকেট ভেন্যুর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমিনি পার্ক’।

মাঠের খেলার বিবেচনায় সবার আগে পাপুয়া নিউগিনি দলের যে গুণটি উল্লেখ করতে হয় তা হলো ফিল্ডিং। এই বিভাগে সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে বেশ এগিয়ে তারা। অন্যান্য সকল টেস্টখেলুড়ে দেশের পর্যায়ে চলে গিয়েছে তাদের ফিল্ডিং দক্ষতা। তাদের দ্রুতগতির ফিল্ডিং বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে ব্যাটসম্যানদের ওপর। এছাড়াও এর ফলে প্রচুর রান আউটের সুযোগও তৈরি করে থাকে তারা।

জাতিগতভাবে পাপুয়া নিউগিনির লোকেরা বেশ শৃঙ্খলাপ্রিয় ও প্রচুর স্ট্যামিনার অধিকারী। এর ফলে তাদের খেলোয়াড়দের ফিটনেস লেভেলও সর্বোচ্চ পর্যায়ের। বোলিং আক্রমণে তেমন দ্রুতগতির কোন পেসার না থাকলেও স্পিন অ্যাটাক বেশ সমৃদ্ধ তাদের। অধিনায়ক আসাদ ভালার পাশাপাশি চার্লস আমিনি, টনি উড়া এবং লেগা সাইকা আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর অন্যতম ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত হন। 
 
তবে জিম্বাবুয়ের মত উত্থান-পতন দেখেছে পাপুয়া নিউগিনির ক্রিকেটও। ২০১৮ সালের মার্চ একটি ‘কালো মাস’ হয়ে থাকবে দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসে। একই মাসে তারা হারিয়ে বসে তাদের আইসিসি ওয়ানডে ও টি টোয়েন্টি স্ট্যাটাস। এবছর এপ্রিলের আগ পর্যন্ত পুনরায় তা দাবিও করেনি তারা। পাপুয়া নিউগিনি দলের কোচ স্বীকার করেন বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে জায়গা পাকা করার পর আবেগী হয়ে পড়েছিল তার দল।

বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দুই বছর তারা অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে গেছে। তাদের জন্য এটা সত্যিই বিশেষ কিছু। আমাদের ও আমাদের জাতির জন্য এটা একটি দারুণ বিষয়। ওয়ানডেতে আমাদের আরো উন্নতি করতে হবে তবে আমরা সবসময়ই মনে করতাম টি টোয়েন্টি আমাদের খেলা।’ 

অধিনায়ক আসাদ ভালা অবশ্য লুকাতে পারেননি তার আবেগ। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা প্রচুর পরিশ্রম করেছি এখানে আসতে।’

পাপুয়া নিউগিনির বিশ্বকাপে আসার পথ

 ২০১৩ ও ২০১৫ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছিল পাপুয়া নিউগিনিকে। ২০১৯ এ অবশ্য তেমন কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের। পূর্ব-এশিয়ার গ্রুপ বি থেকে উঠে এসেছে তারা। ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে যেতে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় তারা। এর মধ্যে পাঁচ উইকেটে হারিয়েছে নেদারল্যান্ডসকে। তাদের একমাত্র হারটি স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে।

যাদের ওপর নজর রাখতে পারেন

দলের সবচেয়ে বড় তারকা অধিনায়ক আসাদ ভালা। ছয় ফুট উচ্চতার এই ব্যাটসম্যানের বল হিটিং সক্ষমতা দারুণ। তিন নম্বরে খেলা ভালা দলটির সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। করতে পারেন অফ স্পিনও।

পাপুয়া নিউগিনির আরেক ভরসা সহ অধিনায়ক আমিনি। দুর্দান্ত ফিল্ডার তিনি। টেলিভেশন ক্যামেরায় বন্দি না হলেও বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ডারদের একজন তিনি। করেছেন দারুণ কিছু রান আউট, নিয়েছেন ক্যাচ। কেবল ফিল্ডিং নন, লেগ স্পিনের সঙ্গে ডেথ ওভারের ব্যাটিংটাও ভালোই পারেন আমিনি।

পাপুয়া নিউগিনির জন্য আরেক ভরসা হতে পারেন নুরমান ভানুয়া। ২০১৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে বারমুডার বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। ডেথ বোলিংয়ের জন্য পারদর্শী এই বোলারের ইয়র্কারটা দারুণ। ব্যাটিংটাও করতে পারেন ভালোই, বিশেষত ফিনিশিং।

টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত পাপুয়া নিউগিনি স্কোয়াড :

আসাদ ভালা (অধিনায়ক), চার্লস আমিনি, লেগা সাইকা, নরম্যান ভানুয়া, নোসাইনা পোকানা, কিপলিন ডোরিগা (উইকেটরক্ষক), টনি উড়া, হিরি হিরি, গৌদি টোকা, সেসে বাউ, দামিয়েন রাভু, কাবুয়া ভাগি-মোরিয়া, সাইমন আতাই, জেসন কিলা, চ্যাড সোপার, জ্যাক গার্ডনার

এবারের বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে পাপুয়া নিউগিনির ম্যাচসমূহ  

ম্যাচ তারিখ  সময়
পাপুয়া নিউগিনির বনাম ওমান   ১৭ অক্টোবর  বিকেল ৪টা
পাপুয়া নিউগিনির বনাম স্কটল্যান্ড ১৯ অক্টোবর                  বিকেল  ৪টা
পাপুয়া নিউগিনির বনাম বাংলাদেশ ২১ অক্টোবর বিকেল  ৪টা

এআইএ/এমএইচ