ব্রেন্ডন টেলর, জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক

সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হয়েছিলেন দুই বছরের জন্য। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তিনি তা করেননি। তবে নিয়ম অনুযায়ী জানাননি আইসিসির এন্টি করাপশন ইউনিটকে। যে কারণে ভোগ করেন শাস্তি। একই অপরাধ করেছেন জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেলর। আইসিসির শাস্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এখন তিনিও।

জিম্বাবুয়েতে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের স্পন্সর হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করার কথা বলে টেলরের সাথে যোগাযোগ শুরু করে ভারতীয় ব্যবসায়ী। পরে তার কাছ থেকে পান ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব। যদিও এমন কিছুতে জড়াননি বলে দাবি করেছেন টেলর। সঙ্গে জানিয়েছেন, পরিবারকে বাঁচাতেই ওই ব্যবসায়ীর প্রস্তাবের কথা কাউকে জানাননি।

২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভারতে ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটি বৈঠকেও বসেন টেলর।

আজ (২৪ জানুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসবা কথা জানান জিম্বাবুয়ে তারকা। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, পরিবারকে বাঁচাতেই জুয়াড়ির সঙ্গে ওই বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছিলেন।

ব্রেন্ডন টেলরের বিবৃতি 

আমার বন্ধু, পরিবার ও সমর্থকদের উদ্দেশ্যে...

গত দুই বছর ধরে আমি একটা ভার বয়ে চলছিলাম। যেটা আমাকে দুঃখজনকভাবে অন্ধকার জায়গায় নিয়ে গেছে এবং আমার মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব রেখেছে। আমি সেটা কাছের মানুষ, বন্ধু ও সমর্থকদের কাছে বলতে পারছি। আমার মনে হয় শুরুর দিকে আমি লজ্জিত ও ভীত ছিলাম।

এটা হয়তো পড়ার জন্য ভালো কিছু হবে না। কিন্তু আইসিসির উদঘাটন করা একটা বিষয়ে আমাকে বিবৃতি দিতেই হবে। আইসিসিও হয়তো শিগগিরই এটি জানাবে।

২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষদিকে, আমাকে ভারতের এক ব্যবসায়ী অনুরোধ করে জিম্বাবুয়েতে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজনের স্পন্সরশিপের বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনায় বসতে। আমাকে বলা হয়েছিল ভারতে যাওয়ার জন্য ১৫ হাজার ডলার দেওয়া হবে।

আমি ওই অনুরোধ প্রত্যাখান করতে পারিনি। কারণ আমি তখন অনেক চিন্তিত ছিলাম। সময়টাও এমন ছিল, যখন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড ছয় মাস আমাদের বেতন দিতে পারছিল না। এটাও নিশ্চিত ছিলাম না, জিম্বাবুয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারবে কি না। তাই আমি ভারতে যাই। আলোচনাও হয়, আমরা একটা ডিনারে বসি।

সেখানে সে (ভারতীয় ব্যবসায়ী) ড্রিংস নিয়ে হাজির হয়। একই সঙ্গে আমাকে কোকেইন সেবনের প্রস্তাব দেওয়া হয়; বোকার মতো আমি সেটা কিছুটা গ্রহণও করে ফেলি। এরপর অনেকবার সেটাতে ফিরে গেছি। আমার পেটে এখনো অসুস্থতা বোধ করি। তারা কীভাবে আমার সঙ্গে ওই রাতে খেলল, সেটা নিয়ে ভাবি।

পরের দিন সকালে ওই একই লোক ঝড়ের মতো আমার হোটেলের ‍রুমে আসে আর একটা ভিডিও দেখায় কোকেইন সেবনের। সে আমাকে বলে, যদি আমি আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাদের জন্য স্পট ফিক্সিং না করি, তাহলে তারা ভিডিওটা পাব্লিক করে দেবে।

আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমার হোটেল রুমে ছয় জন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেকে নিয়েই ভয়ে ছিলাম। আমি তাদের ফাঁদে পা দিলাম। আর ধীরে ধীরে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম যেটা জীবনের তরে ক্যারিয়ারটাকে শেষ করে দিল।

আমাকে ১৫ হাজার ডলার ঠিকই দেওয়া হলো কিন্তু সঙ্গে এটাও বলা হলো যে ফিক্সিংয়ের জন্য এটা একটা ডিপোজিট। যদি কাজটা হয়ে যায়, তাহলে আরও ২০ হাজার ডলার পাব। আমি টাকাটা নিই, যেন প্লেনে উঠে ভারত ছাড়তে পারি। আমার মনে হয়েছিল আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ সেখানে ‘না’ বলার মতো অবস্থা ছিল না। আমি তখন কেবল সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথাই ভেবেছি।

যখন আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। যা কিছু হয়েছে সেটা আমার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যতে প্রভাব ফেলল। আমার অবস্থাটা ‘জগাখিচুড়ি’র মতো হয়ে গিয়েছিল। আমার দাদ (দাউদ, এক প্রকার চর্ম রোগ) হয়ে গিয়েছিল এবং অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ-অ্যামিট্রিপটাইলাইন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

ওই ব্যবসায়ী এসে আমাকে দিয়ে কাজটা করাতে চেয়েছিল যেটা আমি করিনি। আইসিসিকে জানাতে চার মাস সময় লেগে গিয়েছিল। বুঝতে পারছি, এটা অনেক দেরি। কিন্তু আমি ভেবেছি সবাইকে বাঁচাতে পারব, বিশেষত আমার পরিবারকে। আমি নিজের মতো করে আইসিসিকে জানিয়েছি।

আশা করেছিলাম যদি আইসিসিকে ঠিকমতো বোঝাতে পারি যে আমার কতটা দুর্দশা ছিল। আমার নিরাপত্তা ও ভালো থাকার ব্যাপারটা যদি সত্যিকার অর্থে তারা বুঝতে পারে তাহলে হয়তো তারা বুঝবেন কেন আমি দেরি করে জানিয়েছি।

দুর্ভাগ্যবশত তারা সেটা পারেনি। কিন্তু আমি এই বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি না। আমি অনেকগুলো দুর্নীতি বিরোধী সভায় অংশ নিয়েছি বছরের পর বছর ধরে। আমরা জানি কখন কীভাবে জানাতে হবে।

আমি এটাও একই সঙ্গে জানাতে চাই, কখনো কোনো ধরনের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি হয়তো অনেক কিছু করেছি কিন্তু ধোঁকা দিইনি। ক্রিকেটের মতো সুন্দর খেলাটার জন্য আমার ভালোবাসা অনেক বেশি। যেকোনো হুমকিকে পথে ছুড়ে ফেলতে পারি এটার জন্য।

আইসিসিকে জানানোর পর অনেকগুলো সাক্ষাৎকার দিয়েছি। পুরো তদন্তের সময় আমি সৎ ছিলাম। ভেতরে ও বাইরে আমি অনেক যন্ত্রণা পাচ্ছি। এখনো অনেক বিষয়ের জন্য আমার সমর্থন ও পরামর্শ দরকার।

আমাকে বলা হয়েছে, আইসিসি কয়েক বছরের জন্য আমাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। আমি এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছি। আশা করছি, আমার গল্পটা পরে অন্য ক্রিকেটারদের আইসিসিকে (এমন বিষয়ে) দ্রুত জানাতে উৎসাহী করবে।

গত দুইটা বছর আমার জন্য ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের; ব্যক্তিগত ও পেশা দুই জীবনেই। আমার বানানো এই ‘জগাখিচুড়ি’ পরিস্থিতি থেকে আমি বের হতে চাই এবার। আমার পরিবার ও বন্ধুরা আমাকে যেমন অবিশ্বাস্য সমর্থন দিয়েছেন। সেটা আমাকে নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে, আমি এমন একটা সমস্যা তৈরি করেছি যেটা আরও আগে সমাধান করা দরকার ছিল।

আপনাদের এটাও জানাতে চাই, এই ২৫ জানুয়ারি আমি একটা রিহ্যাভ সেন্টারে আসছি নিজেকে শুদ্ধ করতে এবং জীবনের সঠিক পথে ফিরে আসতে। আমাকে এখন নিজের গল্পটা শোনাতে হবে। কারণ আমি জানি, তারা আমার গল্প শুনতে চাইবে। তবে কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি বাইরে চলে যাচ্ছি এবং ভালো হতে চাচ্ছি।

আমার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জন্মেছে। পরিবারের জন্য নিজেকে শুদ্ধ করতে চাই। নিজের ভেতর এমন একটা পদার্থ ঢুকিয়েছি, যেটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আমার স্বপ্নকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমার নৈতিকতা ও সম্মানকেও; যেটাকে আমি অনেক গুরুত্ব দিই।

আমি এটাও আশা করি, আমার গল্প যারা শুনেছে, তাদের এটা অনুপ্রাণিত করবে যেখানে যেখানে সাহায্য দরকার ওইসব ক্ষেত্রে। আমি বুঝতে পারিনি, সামনে এগিয়ে আসা এবং কথা বলা আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবে যেখানে আমি কয়েক বছর ধরে আছি। শেষে এসে বলতে চাই, যাদের দুঃখ দিয়েছি তাদের কাছে ক্ষমা চাই।

আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই পরিবার, বন্ধু ও সমর্থকদের সবসময় আমার পাশে থাকার জন্য। আমি বুঝতে পেরেছি সততার মানেটা কী। সবচেয়ে বড় সম্মান হচ্ছে দেশের অধিনায়কত্ব করা এবং খেলতে পারা। এটার জন্য আমি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ।

এটার জন্যও কৃতজ্ঞ, এই অভিজ্ঞতা আমাকে যা শিখিয়েছে। আমার চারটি সন্তান, ভালোবাসার স্ত্রী, আমার স্বাস্থ্য এবং এখন নিজের যে ভালো ভার্শনটা হতে চাচ্ছি, সেটার জন্যও কৃতজ্ঞতা।

এমএইচ/এটি/জেএস