জাতীয় দলে সর্বোচ্চ ম্যাচ কার-হিসাব নেই বাফুফের
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা কে? এ নিয়ে অনেক দিন তর্ক-বিতর্ক ছিল দেশের ফুটবলাঙ্গনে। পরবর্তীতে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গোলদাতার স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৭ গোল করে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এএফসি’র স্বীকৃতির পরও সাবেক জাতীয় স্ট্রাইকার শেখ মোঃ আসলামের দাবি, বাংলাদেশের জার্সিতে তার ২৪ গোলই সর্বোচ্চ। গোলের বির্তকের বিষয়টি এএফসির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক নিষ্পত্তি হলেও এখন নতুন এক বিতর্ক জেগে উঠেছে-জাতীয় দলের জার্সিতে সর্বোচ্চ ম্যাচ কার?
গতকাল শনিবার তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া বাংলাদেশের হয়ে ৬৫তম ম্যাচ খেলেছেন এবং এটিই বাংলাদেশ দলের হয়ে কোনো ফুটবলারের সর্বোচ্চ ম্যাচ হিসেবে বলছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন কে? এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংরক্ষণ নেই ফেডারেশনের। ফলে একেক জন একেকভাবে ব্যাখ্যা করেন৷ বিশ্বের অনেক ফেডারেশন যেখানে সফটওয়্যার ও আধুনিক উপায়ে ম্যাচের নানা তথ্য ও সংরক্ষণ করে সেখানে বাফুফের এই ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেই।
কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোলের পর নিজেকে সর্বোচ্চ গোলদাতা দাবি করেছিলেন জাহিদ হাসান এমিলি। সর্বোচ্চ ম্যাচের সংখ্যার ক্ষেত্রে সাবেক এই স্ট্রাইকারের বক্তব্য, ‘আমি ৬৪ ম্যাচ খেলেছি বাংলাদেশের জার্সিতে। এতদিন জানতাম সেটাই সর্বোচ্চ। আসলে আমাদের ফুটবলের ইতিহাস ফেডারেশন, ক্লাব ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণে নেই। ফলে এ নিয়ে একটা বিতর্ক হয়। জামালের ৬৫ ম্যাচ হয়ে থাকলে সে আমাকে অতিক্রম করেছে।’
বিজ্ঞাপন
তাকে অতিক্রম করলেও জামালের প্রতি শুভ কামনা জানিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক এমিলি, ‘রেকর্ড হয় ভাঙার জন্যই। আমাদের সময় প্রীতি ম্যাচ, টুর্নামেন্ট কম হয়েছে। না হলে আমার সংখ্যাটা আরো বাড়ত। আমি আশা করি বাংলাদেশের ফুটবলাররা জাতীয় দলের জার্সিতে শততম ম্যাচ খেলুক। জামালের প্রতি শুভ কামনা সে আরো বেশি এগিয়ে যাক।’ ২০১৩ সালে কাঠমাণ্ডু সাফে অভিষেক হয়েছিল ডেনমার্ক প্রবাসী জামাল ভূঁইয়ার। ২০১৬ সালে ভুটানে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্লে-অফ ছাড়া জাতীয় দলের প্রায় সব ম্যাচেই তার উপস্থিতি ছিল। বিভিন্ন রেকর্ডে দেখা গেছে বর্তমানে সক্রিয় জাতীয় ফুটবলারের মধ্যে জামালের পর মিডফিল্ডার সোহেল রানা অর্ধশতাধিক ম্যাচ খেলেছেন।
একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম নিয়মিত মুখ ছিলেন মামুনুল ইসলাম। কয়েক বছর টানা অধিনায়কত্ব করা মামুনুল তার ম্যাচ সংখ্যা নিয়ে একটু প্রশ্ন রেখেছেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় দেখায় আমার ম্যাচ সংখ্যা ৬৩ এবং হিসাব ধরে ২০০৮ এর পর থেকে। আমার অভিষেক ২০০৭ সালে। সেই হিসেবে আমার ম্যাচ বাড়ার কথা।’ ফেডারেশনে এই তথ্য না থাকায় মামুনুল নিজের উদ্যোগে এ নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন বলেও জানিয়েছেন।
নিজের ম্যাচের সংখ্যার পাশাপাশি আরেকটি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন মামুন, ‘এশিয়ান গেমস, সাফ গেমসেও আমরা অনেক ম্যাচ খেলে থাকি। সেই ম্যাচগুলো কিন্তু সিনিয়র জাতীয় দল নয়, অলিম্পিক। ফলে এই বিষয়টিও সতর্ক থাকা উচিত হিসাবের সময়।’
বাংলাদেশের ফুটবলে সোনালী অতীতের অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ নেই পেশাদারিত্বের অভাবে। তখন ফেডারেশনে পেশাদার লোকবল একেবারে কম ছিল। গত দেড় যুগে ফেডারেশনে পেশাদার অনেক লোকবল নিয়োগ হয়েছে। জাতীয় দলের জন্য আলাদা এক্সিকিউটিভও রয়েছেন। এরপরও জামাল, মামুন, এমিলিদের ম্যাচ সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক রয়েই গেছে।
পেশাদারিত্বের যুগে ফেডারেশন পেশাদার লোকবল দিয়ে পরিচালিত হয় নীতি-নির্ধারক নির্বাহী কমিটি। ফুটবলে সাফল্য-ব্যর্থতার দায়ভার কমিটির। সেই কমিটিতে গত ১৪ বছর ধরে রয়েছেন অনেক সাবেক তারকা ফুটবলাররা। সাবেক জাতীয় অধিনায়কের সংখ্যাও ততোধিক। বছর দেড়েক জাতীয় দলের ফলাফল এবং গোলদাতা সম্পর্কে বাফুফে তথ্য চেয়েছিল ফুটবল সংশ্লিষ্ট সবার কাছে। জাতীয় দলের ম্যাচ সংখ্যা, সর্বোচ্চ কে খেলেছে, কার অধিনায়কত্ব বেশি এসব তথ্য উদঘাটনে তেমন কার্যকরি উদ্যোগ দেখা যায়নি সাম্প্রতিক সময়ে।
গত এক দশক বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক জাতীয় অধিনায়ক আরিফ হোসেন মুন। জাতীয় দলের তথ্য সংরক্ষণের বিষয় বলেন, ‘এটি সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটি নয়, সামগ্রিক সবারই দায় রয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির দিকে নজর দেয়া হয়নি,অথচ এটি অবশ্যই আমাদের ফেডারেশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আন্তরিকভাবে দেখলে এ সকল তথ্য সংরক্ষণ খুব কঠিন কিছু নয়।’
দেশের ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তি শেখ মোঃ আসলাম। ২০০৮-২০ সাল পর্যন্ত তিনি ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবে ছিলেন। এক যুগ সময়ের মধ্যেও এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘মাঝে এই বিষয়গুলো নিয়ে হালকা আলোচনা হলেও নানা কারণে এড়িয়ে গেছে। ফলে ইতিহাস আর সংরক্ষণ হয়নি। যার ফলে অনেক কিছুর বিচ্যুতি হয়েছে।’ এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাও তার চোখে ধরা পড়েছে, ‘ফেডারেশনের কাছে সুনির্দিষ্ট রেকর্ড না থাকার ফলে অনেক ফুটবলারই নিজেকে জাতীয় ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আদৌ যারা জাতীয় দলে খেলেননি।’
ফুটবল ফেডারেশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি কাজী সালাউদ্দিন নিজেই সাবেক জাতীয় অধিনায়ক। তার পরের পদে থাকা সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ঘরোয়া লিগে সর্বোচ্চ ২৭ গোলদাতা। এমন দুই ফুটবল ব্যক্তিত্ব দেশের ফুটবলে এক যুগের বেশি সময় দায়িত্বে এবং তাদের অধীনে অনেক পেশাদার জনবল থাকার পরও ফুটবলপ্রেমী জাতিকে তারা জানাতে পারেননি দেশের হয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন কে? বাংলাদেশ কার নেতৃত্বে সর্বাধিক ম্যাচ খেলেছে!
এজেড/এটি/এইচএমএ