এমন কিছুর দেখা তো কালেভদ্রেই মেলে। আর যাই হোক, ফুটবল মাঠে হাত দিয়ে গোল করার দৃশ্য, কিংবা মাঝমাঠ থেকে কাউকে উঠে এসে পুরো প্রতিপক্ষ রক্ষণকে বোকা বানিয়ে গোল করতে তো হরহামেশাই দেখা যায় না! এমন দুটো গোল একই ম্যাচে করার অচিন্তনীয় কাজটাই করে বসেছিলেন ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। ‘চিরশত্রু’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই গোল দুটোই  আর্জেন্টাইন মহাতারকাকে অমরত্বের সন্ধান দিয়েছিল ১৯৮৬ সালের আজকের এই দিনে।

ম্যাচের বিল্ড আপের গল্পটা শুনুন। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনাকে নামতে হতো অ্যাওয়ে জার্সি পরে। বিশ্বকাপের আগে যে অ্যাওয়ে কিট চূড়ান্ত করা হয়েছিল, তার রঙ ছিল গাঢ় নীল, তাতে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল; মেক্সিকোর গরমে তা পরে খেলাটা খুব কষ্টকর ছিল। মহারণের আগে কোচ কার্লোস বিলার্দো তাই খুঁজছিলেন হালকা নীল রঙা কোনো জার্সি। দলের স্টাফরা খুঁজেপেতে দুটো জার্সি আনলেন, তবে বিলার্দোর মন ভরছিল না তাতে। তখনই হুট করে কোত্থেকে এসে হাজির ম্যারাডোনা। একটা জার্সি হাতে তুলে দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘বাহ, জার্সিটা সুন্দর, আমরা এটা পরেই ইংল্যান্ডকে হারাব।’ ব্যস, সেটাই হয়ে গেল আর্জেন্টিনার ইংল্যান্ড ম্যাচের জার্সি।

তবে ম্যারাডোনার কথা অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড আর্জেন্টিনা মহারণে ফলছিল না, অন্তত প্রথম ৪৫ মিনিটে ফলেনি। ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো দর্শকের অধীর অপেক্ষা শেষ হয়নি প্রথমার্ধে। দ্বিতীয়ার্ধে নিজেই মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। প্রতিপক্ষের ভুল থেকে পাওয়া ‘লং বল’ বক্সের ভেতর পেয়ে হেডারের ভান করে বাঁহাতে ছুঁইয়ে জড়ালেন জালে। ফুটবল বিশ্ব দেখল কুখ্যাত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোল। 

সতীর্থরা বুঝতে পেরে এগোচ্ছিলেন না খুব একটা, ম্যারাডোনা নিজ ভাষায় বলছিলেন, ‘আরে এগোচ্ছো না কেন তোমরা? গোলটা বাতিল হয়ে যাবে তো!’ তিউনিসিয়ান রেফারি শেষমেশ গোলটা দিয়েই বসলেন আর্জেন্টিনাকে, ইংলিশদের তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ার দশা। 

ফকল্যান্ড যুদ্ধের কারণে আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ডের সম্পর্কটা ছিল বৈরিতার। ম্যাচের আগেও ঘুরে ফিরে আলোচনায় উঠে আসছিল বিষয়টা। আর তাই ম্যাচটা রূপ নিয়েছিল যুদ্ধে, সেটা আক্ষরিক অর্থেই! ম্যাচের আগে ঘটেছিল হাতাহাতির ঘটনা, বেশ কিছু সমর্থককে নিয়ে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। এমন বৈরি পরিবেশে ম্যারাডোনার এমন ‘আইকনিক’ গোল আর্জেন্টাইনদের মনে তাকে চিরকাল গেঁথে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

তবে ম্যারাডোনা যদি তাতেই সন্তুষ্ট হবেন, তাহলে তিনি ম্যারাডোনা কেন? তিনি সন্তুষ্ট হননি। তার প্রমাণ মিলল তার মিনিট চারেক পর। একটা ঐতিহাসিক ‘সোলো’ প্রচেষ্টা, একটা ‘ক্লিনিকাল ফিনিশ’ শেষে পিটার শিলটন আর পুরো ইংলিশ রক্ষণকে ধুলোয় মিশিয়ে তিনি যখন ছুটছেন গ্যালারির দিকে, ততক্ষণে ইতিহাসের পাতাতেই যে অমর হয়ে গেছেন! 

সে গোলের বিল্ডআপটা হয়েছিল পিটার বিয়ার্ডস্লের একটা ভুলে। এর একটু পর এক্তর এনরিকের পাস গেল ম্যারাডোনার কাছে, যিনি ছিলেন নিজেদের অর্ধে। বল পায়ে একটু ঘুরলেন। একটু পর যা করলেন, ম্যারাডোনা নাচিয়ে হলে তাকে ‘পিরোয়েট’ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত অবলীলায়, ব্যালে নাচিয়েদের মতো করে ঘুরে গ্যারি স্টিভেন্সের চ্যালেঞ্জ এড়ালেন। পিটার রেইড তখন তার কাছে চলে এসেছিলেন, তবে হাফ টার্নে ম্যারাডোনা ছিটকে ফেললেন তাকেও। 

এতক্ষণ এতকিছু ম্যারাডোনা করছিলেন তার ‘দুর্বল’ ডান পায়ে, রেইডকে ছিটকে ফেলার পর বলটা বাম পায়ে নেওয়ার ফুরসত মিলল একটু। রেইডকে অবশ্য পুরোপুরি ছিটকে দিতে পারেননি, সামলে নিয়ে তিনি কিছু দূর পিছু পিছু গিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন জাদুকরের। তবে কিছু দূর যেতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

দুই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে এরপর ম্যারাডোনা এগিয়েছেন দুর্বার গতিতে। টেরি বুচার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন তাকে রোখবার, তবে আগের দু’জনের ব্যর্থ হলো সেটাও। বক্সে ঢোকার মুখে টেরি ফেনউইক একটা দুর্বল চ্যালেঞ্জ করে বসলেন তাকে, ছোট্ট একটা বডি ফেইন্টে ম্যারাডোনা বোকা বানালেন তাকেও।  

সামনে এবার ছিলেন শুধু ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটন, বক্স থেকে বেরিয়ে এসে যিনি ম্যারাডোনার জায়গা কমিয়ে দিতে চাইছিলেন। তিনি একটা স্টেপ ওভারে ছিটকে দিলেন তাকেও। ততক্ষণে আবার বুচার এসে পেছন থেকে ট্যাকল করে বসেছিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে, কিন্তু ততক্ষণে তিনি পগারপার, ম্যারাডোনার ডান পায়ের আলতো ছোঁয়ায় বলটা তখন গিয়ে হুটোপুটি খাচ্ছে জালে!

ম্যারাডোনার মৃত্যুর পরদিন সেই গোলের স্মৃতি স্মরণে গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, ‘আপনি ট্যাকল দিচ্ছেন, সে আপনার পায়ের নিচ দিয়ে বল বের করে নিয়ে যাচ্ছে, এমনভাবে বল নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছিল, যেন তার সামনে কেউ নেই… এই বিষয়টা বিস্ময়জাগানিয়া ছিল। সেদিনই সম্ভবত কারো গোল দেখে আমার মনে হয়েছিল আমার একটা হাত তালি দেওয়া দরকার; তবে আমি তা করিনি, কারণ তাহলে বাড়িতে গেলে আমাকে ধ্বংস করে ফেলা হতো।’ 

সেই গ্যারি লিনেকারের, ম্যারাডোনার বিতর্কিত ‘হ্যান্ড অফ গড’ গোলের সবচেয়ে কাছের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যিনি। চিরশত্রুদের মুখোমুখি হয়ে এমন ‘বিতর্কিত’ গোল তিক্ততাই সৃষ্টি করেছিল ইংলিশদের মনে। মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে লিনেকারের মনে থাকা সে তিক্ততাটাকে ম্যারাডোনা বদলে দিলেন মুগ্ধতায়। 

সেই গোল পরে বনে গেছে গত শতাব্দীর সেরা গোল। বিশ্বকাপেরই সেরা গোল সেটা কি না, তা নিয়েও আলোচনা হয় বিস্তর। তবে সেই ম্যাচের চার মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল ইতিহাসের পাতাতেই জায়গা করে দিয়েছিল তাকে। নাহয় তার মৃত্যুর পর, সেই গোলের ৩৬ বছর পরও আজ সে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কী করে?

এনইউ/এটি