বসফরাস প্রণালী ইউরোপ ও এশিয়াকে আলাদা করেছে। তাদের আবার এক করেছে বসফরাস ব্রিজ, ইস্তাম্বুলকে দিয়েছে দুই মহাদেশের স্বাদ। ইস্তাম্বুল শহরের এক অংশ পড়েছে ইউরোপে আরেক অংশ এশিয়ায়। ইউরোপের অংশ থেকে ব্রিজ পার হয়ে এশিয়ান অংশে আসলে চোখে পড়বে ফেনারবাচের সুবিশাল স্টেডিয়াম। 

তুরস্কের আরো দুই শীর্ষ ক্লাব গালাতাসারাই ও বেসিকতাস ইউরোপের অংশে পড়েছে। এশিয়ার অংশে বড় ফুটবল ক্লাব ফেনারবাচেই। ফুটবল যে শুধু খেলা নয়, সংস্কৃতি, রুচি এবং ইতিহাসেরও বড় অংশ এটি টের পাওয়া গেল ফেনারবাচে ক্লাবে এসেই। 

ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলায় সমর্থকই খেলার প্রাণ। ফেনারবাচে সমর্থকদের দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে মনে করে। তাই ১২ নম্বর জার্সি সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত। ফুটবলারদের এই জার্সি দেন না তারা। খেলোয়াড়দের টানেলে ১২ নম্বর জার্সির একটি প্রতিকৃতি রয়েছে। 

টানেলের এক পাশে দেখা গেল বেশ কয়েকটি দেশের পতাকা। এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি দেশের ফুটবলাররা ফেনারবাচেতে খেলেছেন সেই দেশের পতাকা রয়েছে সেই কর্ণারে। শুধু বিদেশি খেলোয়াড় নয়,বিদেশি কোচদেরও দেশের পতাকা রয়েছে। 

ফেনারবাচেতে খেলা বিদেশি খেলোয়াড়, কোচদের যেমন সম্মান তেমনি সম্মান দেখা গেল অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে আসা কিংবদন্তিদেরও। অ্যাওয়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে চোখে পড়ল জিনেদিন জিদান, ইব্রাহিমোভিচ, রুনির মতো কিংবদন্তিদের জার্সি। 

৫০ হাজার আসন বিশিষ্ট স্টেডিয়ামের গ্যালারির বিশালতা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। অ্যাওয়ে দলের সমর্থকদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত। নিজ দলের অন্তপ্রাণ সমর্থকদেরও আসন রয়েছে আলাদা। ক্লাব চলে পৃষ্ঠপোষকতায়। সেই স্পন্সরদের জন্য রয়েছে আলাদা জোন। ক্লাবের সভাপতি ও পরিচালকরা বসেন আলাদা জোনে। সেই সকল আসন অবশ্য সীমিত। গ্যালারির আসনের ৮০ শতাংশই সাধারণ ফেনারবাচের সমর্থকদের জন্য। তুরস্ক লিগে গোলপোস্টের পেছনে সর্বনিম্ন টিকেটের দাম ২০০ লিরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও উয়েফার ম্যাচে সেই টিকেটের দাম হয় দ্বিগুণ। 

মাঠ, গ্যালারি, ড্রেসিং রুম ও টানেল যে মুগ্ধতা উপহার দিয়েছে তা নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল জাদুঘরের কাছে যেতে। স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় এক অংশের বিশাল জায়গা জুড়ে জাদুঘর। ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া ক্লাবের ১১৫ বছরের ইতিহাস আর স্মরণীয় ঘটনা কয়েক বর্গমিটারে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ক্লাবের গোড়াপত্তন যাদের হাতধরে তাদের প্রতিকৃতি সবার আগে রয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে ক্লাবের বিকাশে যারা অবদান রেখেছেন তাদের নামও খোদাই করা রয়েছে। ফেনারবাচেকে যারা বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি দিয়েছেন সেই সকল খেলোয়াড়দের জার্সি, বুট ও প্রতিকৃতি সুন্দর করে সাজানো। ১১৫ বছরের ইতিহাসে রয়েছে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ট্রফি। সেই সকল ট্রফিগুলো সুন্দরভাবে সুসজ্জিত। 

পেলের সঙ্গে ফেনারবাচের স্মৃতিও বিশেষভাবে ধরে রেখেছে ক্লাবটি। শতবর্ষী ক্লাবের অনেক ফুটবলার দুই বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সকল যুদ্ধে নিহত ফুটবলারদের জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার। আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কও ফেনারবাচে পরিদর্শন করেছেন। রয়েছে সেই ছবি ও শুভেচ্ছাবাণীও৷

ফুটবল ক্লাব হিসেবেই ফেনারবাচের জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে বিশ্বে। তবে বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল সহ অন্য খেলাও খেলে এই স্পোর্টিং ক্লাবটি। ফুটবলের পাশাপাশি অন্য খেলার ট্রফি ও অর্জনও আছে জাদুঘরে। এই ক্লাবের সাবেক এক খেলোয়াড়ের নাম রয়েছে বিশেষভাবে। যিনি একদিন ফুটবলে গোল করে ফেনারবাচেকে জিতিয়েছেন ঐ একই দিন আবার বাস্কেটবলও দলকে জিতিয়েছেন। তুরস্কের ক্লাব তাদের বিশেষ খেলোয়াড়দের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দিয়েছে।

সত্তরের দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনে এ রকম কৃতিত্ব ছিল প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, রামা লুসাইদের। যারা ফুটবল ও হকি একই দিন মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন। বাংলাদেশে এদের গল্প শুধু মুখেই, তুরস্কের মতো সোনার হরফে বাঁধিয়ে রাখা নয়। ইতিহাস সংরক্ষিত না থাকায় এক প্রজন্মের অবর্তমানে প্রতাপ-রামাদের অসামান্য কীর্তি একদিন বিলীন হয়ে যাবে, এমন একটা আফসোসও সঙ্গী হলো শেষে।

এজেড/এটি