ক্লাবপাড়া আরামবাগে বেড়ে ওঠা আবু নাঈম সোহাগের। বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল, নটরডেম কলেজের পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় তিনি স্নাতক করেন। দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও ২০০৫ সালে সোহাগ ফুটবল ফেডারেশনে কম্পিটিশন ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। পদটির কাজ হচ্ছে- খেলার ফিকশ্চার ও বাইলজ তৈরি এবং ক্লাবগুলোর সঙ্গে ফেডারেশনের যোগাযোগ সম্পন্ন করা। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি এই কাজগুলোই করে আসছিলেন। 

বাংলাদেশের ফুটবলে বিশেষ একটি বছর ২০০৮ সাল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে এসেছে। সেই সময় সংগঠকরা সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত/নির্বাচিত হতেন। ২০০৮ সালে গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক পদে সংগঠকের পরিবর্তে পেশাদার কাউকে নিয়োগের বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত হয় এবং সভাপতি হন ফেডারেশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

আরও পড়ুন >> ফিফার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মুখ খুললেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী
 
একই বছর ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তী কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি হওয়ার প্রথম এক বছর সাধারণ সম্পাদক পদটি ছিল শূন্য। ২০০৯ সালে ক্রীড়া সাংবাদিক আল মুসাব্বির সাদী পামেলকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তুখোড় এই সাংবাদিক অল্প দিনের মধ্যেই ফেডারেশনের প্রশাসনিক বিষয়ে বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। কিছুদিন পরই তার সামনে বাধ সাধে দুরারোগ্য ক্যান্সার। পামেল অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আবু নাঈম সোহাগ ফেডারেশনের দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১১ সালের ২০ মে পামেলের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সোহাগকে। তার দায়িত্বটি ভারপ্রাপ্ত হলেও সোহাগের চেয়ার পরিবর্তন হয়নি। কম্পিটিশন ম্যানেজারের চেয়ারে বসেই তিনি ভারপ্রাপ্তের কাজ চালাতেন।

২০১২ সালে পুনরায় বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হন কাজী সালাউদ্দিন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরই আবু নাইম সোহাগকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাকে সম্পাদক নিয়োগ দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সেই সময় সালাউদ্দিন জানিয়েছিলেন, ‘আমার হাতে যোগ্য বিকল্প নেই’। ফেডারেশনে তখন এক্সিকিউটিভের সংখ্যা কম ছিল এবং সোহাগ সেই সময় ছিল অন্যদের মধ্যে অভিজ্ঞ এবং উচ্চ শিক্ষিত।

আরও পড়ুন >> বাফুফে থেকে মুছে গেল সোহাগের নাম!

পরের বছর পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আলাদা কক্ষ পান সোহাগ। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ক্রমেই তিনি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠভাজন হয়ে উঠেন। সালাউদ্দিন এতটাই সোহাগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, অনেক সময় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের চেয়ে সোহাগের মন্তব্য বা পরামর্শকেই বেশি মূল্য দিতে থাকেন। বিশেষ করে সালাউদ্দিন তৃতীয় মেয়াদে বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সোহাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
 
২০১৬ সাল পর্যন্ত বাফুফে ছিল ক্রীড়াঙ্গনের অনেকের আড্ডাখানা। বিশেষ করে সহ-সভাপতি বাদল রায়ের রুমে ক্রীড়া ও রাজনীতির নানা লোক আসতেন। সেখানে ভিড় থাকত সাংবাদিকদেরও। ২০১৬ সালে বৃটিশ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিকে নিয়োগ দেয় বাফুফে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পল ও সোহাগ মিলে ফেডারেশনে সবার অবাধ যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা দেন। ফেডারেশনের মূল প্রশাসনিক জায়গা দ্বিতীয় তলা। সেখানে তারা কয়েক স্তরের নিরাপত্তা তৈরি করেন। এর ফলে সাবেক ফুটবলারদের অনেক সংগঠকই ফেডারেশনে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হন। এই সমস্যায় পড়েছিলেন ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ হোসেন মুনও।
 
২০১৬ সালের আগে বাফুফের প্রচুর আর্থিক সংকট ছিল। সে সময় ফিফা ও এএফসির তেমন অনুদান ছিল না। ইনফান্তিনো ফিফা সভাপতি হওয়ার পর থেকে ফরোয়ার্ড প্রোগাম চালু করে এবং বার্ষিক অনুদানও বাড়ায়। ফিফার এথিকস কমিটি যে তদন্ত করেছে সেখানে ২০১৬-২০ সালের আর্থিক বিষয়গুলোই মূলত উঠে এসেছে। ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র সহ-সভাপতি হলেও আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও সোহাগের ভূমিকাই ছিল বেশি। এমনকি সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের স্বাক্ষর খুবই কম থাকলেও, আর্থিক বিষয়ে সভাপতির মাধ্যমে সোহাগ প্রভাব খাটিয়েছেন বলে ধারণা ফুটবল ফেডারেশনের অধিকাংশের।

আরও পড়ুন >> ধোঁয়াশা রেখেই সম্মেলন কক্ষ ছাড়লেন সালাউদ্দিন

সোহাগ সালাউদ্দিনের আস্থাভাজন হওয়ায় অনেক কর্মকর্তা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে বিষয়টি নীরবে চেপে গেছেন। সাবেক তারকা ফুটবলার বাদল রায় ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি ফেডারেশনের অনিয়ম নিয়ে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ব্রেন-স্ট্রোক থেকে সেরে ওঠে ফেডারেশনে আবার কর্মকাণ্ড শুরু করলে, সোহাগের সঙ্গে তার বাকবিতন্ডা হয় এবং আকস্মিকভাবে ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সেই সময় সোহাগের পক্ষই নেন। সাবেক অনেক ফুটবলার সোহাগের শাস্তি দাবি করলেও, বাফুফে সভাপতি কোনো পদক্ষেপই নেননি।

সেই চাপা ক্ষোভ মনে রেখেই বাদল রায় ২০২০ সালে দুনিয়া ত্যাগ করেন। তার মতো প্রতিবাদী লোক ফেডারেশনের কমিটিতে না থাকায় সোহাগের জবাবদিহিতার মাত্রা আরও কমে যায়। সহ-সভাপতিদের মধ্যে বাদল রায়ই প্রতিনিয়ত ফেডারেশনে যেতেন। ২০২০ সালে নির্বাচিত সহ-সভাপতিরা ফেডারেশনে সেভাবে নিয়মিত নন। সদস্যদের বসার জন্য সুনির্দিষ্ট কক্ষও নেই (মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া)। ফলে ফেডারেশনে সোহাগের একচ্ছত্র প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে কাজী সালাউদ্দিনের প্যানেলের জন্য পেছন থেকে নানা কাজও করেছেন এই সোহাগ।
 
২০২০-২৩ এই সময়কালে সোহাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানকে অনুমতি বা অবহিত না করেই তিনি অনেক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়েছেন। অনেক সময় সভাপতিকে এসব বিষয়ে জানালেও তেমন কোনো প্রতিকার আসেনি। অর্থ, প্রশাসন ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নসহ সব কিছুতেই সোহাগ গত তিন বছর অত্যন্ত ফ্রি স্টাইল ছিলেন। যার কারণে বলা চলে, সাম্প্রতিক সময়ে মূলত সোহাগই পরিচালনা করেছেন ফুটবল ফেডারেশন। অনেক ক্ষেত্রে কাজী সালাউদ্দিন সোহাগের পরামর্শকে সিদ্ধান্তে রূপ দিয়েছেন বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন >> ‘ফিফার প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট’

সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ সম্পাদক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সহ-সভাপতিদের বেশিরভাগেরই ফোন ধরতেন না। এই বিষয়ে সোহাগকে প্রশ্রয় দিয়ে সালাউদ্দিন সাম্প্রতিক সময় বলেছিলেন, ‘সোহাগ তো আমার ফোনও ধরে না। সোহাগকে এসএমএস করি ‘‘কল মি।’’ এরপর ও ফোন করে।’

সোহাগের প্রতি কাজী সালাউদ্দিনের মতো ব্যক্তির এত নির্ভরশীলতা কেন এ নিয়ে ফেডারেশনের অনেকেই ক্ষুব্ধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘১৫ বছরের বেশি সময় সভাপতি থাকলেও তার প্রশাসনিক দক্ষতা সেভাবে নাই। তাই সোহাগের ওপরই তার এত নির্ভরশীলতা।’
 
গণমাধ্যমের সামনে বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোহাগ মিষ্টভাষী হলেও ফেডারেশনের অন্য পেইড এক্সিকিউটিভদের সঙ্গে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিম্নস্তরের কর্মচারীরা অনেক দিন থেকেই ফেডারেশনে কাজ করেন। দুঃখভরা কণ্ঠে তারা বলেন, ‘সাদী (প্রয়াত সম্পাদক আল মুসাব্বির সাদী পামেল) স্যার মাটির মানুষ ছিলেন। আর উনি...।’

এজেড/এএইচএস