ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের কথা মনে আছে? কিংবা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইসিএল) কথা? প্রথমটার ব্যাপারে হয়তো আপনি নাও জেনে থাকতে পারেন তবে দ্বিতীয় ঘটনাটা আপনার সাফ মনে থাকার কথা, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যে এক ঝটকায় অভিভাবকশূন্য করে একঝাঁক তারকা ক্রিকেটার ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিল টুর্নামেন্টটা! 

তেমন কিছু এবার ঘটছে ইউরোপিয়ান ফুটবলেও। এসেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো টুর্নামেন্ট ইউরোপিয়ান সুপার লিগের ঘোষণা। ফিফা, উয়েফা এমন ঘোষণাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে, পরিণাম কী হতে পারে তাও জানিয়ে দিয়েছে দুই প্রতিষ্ঠান।

এর বিরুদ্ধে উয়েফার অবস্থানটাই সবচেয়ে কঠিন। দিনশেষে তাদের অস্তিত্বই তো সংকটে ফেলছে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বর্তমানে উয়েফার সবচেয়ে বড় অর্থকরী টুর্নামেন্ট। সুপার লিগ এলে এর শক্তি খর্ব হবে বহুগুণে, যার আর্থিক পরিণামটাও খুব একটা সুখকর হবে না। এ জন্যেই তো এর বিরুদ্ধে ‘শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার’ ঘোষণাই দিয়েছে উয়েফা!

সুপার লিগের ফরম্যাট কেমন হবে?

এ নিয়ে বিশদ কিছু জানা যায়নি এখনো। কিন্তু রোববার রাতে সুপার লিগ কর্তৃপক্ষ অবশেষে বিবৃতি দিয়েছে, এবং নিজেদের ওয়েবসাইটও প্রকাশ করেছে। 

২০টি দল দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে হোম আর অ্যাওয়ে ভিত্তিতে। দুই গ্রুপের শীর্ষ তিন দল সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে, আর শেষ আটের বাকি দুটো দল আসবে দুই গ্রুপের চার-পাঁচ নম্বর দলের মধ্যকার প্লে অফ শেষে। ফলে প্রত্যেক মৌসুমে কমপক্ষে ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ২৫টি ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকছে প্রত্যেক দলের সামনে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফরম্যাটে যে সংখ্যাটা মাত্র ১৩, আর প্রস্তাবিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফরম্যাটে সংখ্যাটা উন্নীত হবে ১৭-তে।

অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে বলা হয়েছে, সুপার লিগের একটা নারীদের সংস্করণও আসবে অচিরেই। পুরুষদের লিগের মতো নারীদের লিগটাও হবে ‘ঘরোয়া লিগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই।’ 

তবে ফরম্যাটের চেয়েও বেশি জরুরী যে বিষয় সেটা হচ্ছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আর দেখা যাবে না দলগুলোকে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্যে যে বিষয়টা বড় এক ধাক্কা হয়ে আসবে তা বলাই বাহুল্য। হাজার হোক, এটা ইউরোপিয়ান ফুটবল, এনবিএ নয়। 

কারা খেলবে এখানে?

এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে, ১৫টি ক্লাব এর প্রতিষ্ঠাতা ক্লাব হিসেবে থাকবে। যার ১২ দলের নাম প্রকাশিত হয়েছে। গুঞ্জন আছে বাকি তিন দল হতে পারে বায়ার্ন মিউনিখ, পিএসজি ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। বাকি পাঁচ দল হবে আগের মৌসুমে পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে।

কেন এ সিদ্ধান্ত? 

সোজাসাপ্টা উত্তর, অর্থের ঝনঝনানি। সে লিগে খেলবে ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ের সব ক্লাব। আপনিই বলুন, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা ম্যানচেস্টার সিটি-জুভেন্তাসের ম্যাচ দেখার জন্য আপনি টিভি সেটের সামনে বসবেন নাকি ডিনামো জাগরেব আর স্পার্তাক মস্কোর ম্যাচ দেখতে মুখিয়ে থাকবেন?

উত্তরটা সহজ, সে কারণেই অনেক আগে থেকেই বড় দলগুলো এই ম্যাচগুলোর রাজস্ব ভাগ হয়ে যাওয়াটার বিপক্ষে কথা বলছিল, নিজেদের ভাগের বড় অংশ চাওয়া হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। 

তবে ভোটের কথা ভেবে সে চাওয়ায় কান দেয়নি উয়েফা। দিনশেষে ভোটের ক্ষেত্রে তো আর বড়-ছোটর ভেদাভেদ নেই! আর এই বড় ফেডারেশনের চেয়ে ছোটদের সংখ্যাই ইউরোপে তুলনামূলক বেশি। আর তাই, এ সিদ্ধান্ত সুদূরপ্রসারী একটা প্রভাবও ফেলার সম্ভাবনা রাখে, সেজন্যেও বড় ক্লাবগুলোর দাবিতে এতদিন কান দেয়নি উয়েফা।

সেখান থেকেই নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলে কোষাগার স্ফীত করার ধারণাটা মাথায় আসে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। ভাবুন একবার, প্রতি সপ্তাহান্তেই একবার করে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানইউ, সিটি, লিভারপুলের মতো দল একবার করে খেলছে একে অপরের বিপক্ষে। তাতে টিভি রাজস্ব, স্টেডিয়াম টিকিট বিক্রিও না বেড়েই যায় না। 

সঙ্গে আছে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যও। মাঠে গড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যেই হয়তো এশিয়া কিংবা উত্তর আমেরিকায় দেখা মিলবে এই সুপার লিগের। তাতে আছে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনাও।

পাশাপাশি আছে প্রতিযোগিতায় নিশ্চিত খেলার সুযোগও। প্রতিষ্ঠাতা ক্লাবের জায়গা নিশ্চিতই থাকবে লিগে, বাকি পাঁচ দল থাকবে উত্তরণ-অবনমনের মধ্যে। নিশ্চিত খেলা মানে নিশ্চিত প্রাইজমানি জেতা, নিশ্চিত রাজস্বের হাতছানিও। 

এদিকে সাইনিংয়ের অর্থটাও নেহায়েত কম নয়। কেবলমাত্র চুক্তি স্বাক্ষর করলেই আপনি পাচ্ছেন ৪২৫ মিলিয়ন ইউরো, করোনা মহামারি আর মন্দার সময়ে এমন অর্থ কে দিচ্ছে আপনাকে? সব মিলিয়েই ইউরোপের শীর্ষ দলগুলো এ সিদ্ধান্তে হ্যাঁ ভোট দিয়েছে।

ফিফা-উয়েফার অবস্থান কী?

ফিফা আর উয়েফা অবধারিতভাবেই এর বিরুদ্ধাচারণ করছে। শীর্ষ ইউরোপীয় লিগগুলোকে সঙ্গে নিয়ে উয়েফা জানিয়ে দিয়েছে, সুপার লিগে খেললে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে ঘরোয়া লিগের। এদিকে ফিফা বলছে খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিষেধাজ্ঞার কথা। 

তবে শেষমেশ উয়েফার সিদ্ধান্ত কী হবে তার উত্তর মিলবে আজ সোমবার। নিজেদের মধ্যে জরুরী কার্যনির্বাহী সভার পরই সংবাদ সম্মেলনে আসার কথা উয়েফা মুখপাত্রের।

সোমবার কী হবে? 

উয়েফা সভাপতি আলেক্সান্দার সেফেরিনের কাছে এখন পথ খোলা আছে দুটো। এক, তিনি এগিয়ে এসে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। সেক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাজস্ব বন্টন, টুর্নামেন্টে নিশ্চিত জায়গা আর প্রতিযোগিতায় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দরকষাকষির সুযোগ থাকবে দুই পক্ষের, সুপার লিগে যেটা প্রত্যেক দলের কাছেই আছে। সেক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নতুন ফরম্যাটের বিষয়টা ত্বরান্বিত হতে পারে আরও।

আরেকটা পথ, ১২টা দলকে কোনঠাসা করে দেওয়া, নিজেদের অবস্থানে অটল থেকে ক্লাবগুলোকে পিছু হটতে বাধ্য করা। উয়েফা কোন পথে হাঁটবে, তার উত্তরই মিলবে আজ।

যদি কোনো পক্ষই না সরে নিজেদের অবস্থান থেকে, তাহলে কি আর বার্সা-রিয়ালকে দেখা যাবে না লা লিগায়, কিংবা সিটি-লিভারপুলকে প্রিমিয়ার লিগে? 

কাগজে কলমে, হ্যাঁ। তাদের সে ক্ষমতাটা আছে। কিন্তু বিষয়টার ইতি আদালতেও ঘটতে পারে। আপনি যদি কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজক হন (যেমন ফিফা, উয়েফা, এফএ), আপনি অবলীলায় কোনো দলকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে যারা নিষিদ্ধ হচ্ছেন, তারা আপনার নামে মামলাও ঠুকে দিতে পারেন। আর তাই আপাতত অপেক্ষা করাটাকেই সেরা বিকল্প বলে মনে হচ্ছে উয়েফার জন্য।

ফুটবলে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে এটা? 

ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ হোক, আর আইসিএল। দুটো টুর্নামেন্টই খুব বেশিদিন টিকতে পারেনি, তবে ক্রিকেটের নিয়মনীতি আর রেওয়াজে বড় পরিবর্তনই আনতে পেরেছিল। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ যে খুব সহসাই মিলিয়ে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে যা আঁচ করা যাচ্ছে তা হলো, ফুটবলকে খোলনলচে পালটে দিতেই মাঠে আসছে এই ইউরোপিয়ান সুপার লিগ।

এনইউ/এটি