দুয়ারে চলে এসেছে আরেকটা ইউরো। এইতো আর মাত্র একদিন পরেই পর্দা উঠবে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরের। ২৪ দলের এই লড়াইয়ের নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যবহুল লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ঢাকা পোস্টে। আজ থাকছে ‘ডি’ গ্রুপ নিয়ে আলোচনা-

২০১৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। এরপর থেকে নেশন্স লিগের সেমিফাইনাল, বাছাইপর্বের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স... ইংল্যান্ডের পারফর্ম্যান্সের গ্রাফটা নেহায়েত মন্দ নয়। সঙ্গে যখন যোগ হবে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের মিশেল, ইংলিশরা আপনার হিসেবের খাতা ওপরের দিকে না থেকেই যায় না।

তবে দলটাকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে ইতিহাস, যে কাজটা গ্যারি লিনেকাররা পারেননি, ওয়েইন রুনি, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, পল স্কোলস, স্টিভেন জেরার্ডরা পারেননি, সেটা করে দেখাতে পারবেন তো হ্যারি কেইনরা? তাদের গ্রুপসঙ্গী আবার বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া, উদীয়মান স্কটল্যান্ড, আর চেক প্রজাতন্ত্র, ইউরো বাছাইয়ে যাদের কাছে হেরেছিল কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা। ফলে ইংলিশদের সামনে যে অপেক্ষা করছে বন্ধুর পথ, তা হলফ করেই বলা যায়।

ইংল্যান্ড

১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জয়। এরপর থেকে ইংল্যান্ড দলে কত বড় বড় নাম খেলে গেছেন, তবু শিরোপা রয়ে গেছে অধরাই। আসছে ইউরোয় আবার ইংলিশদের সুযোগ সেই খরা মোচনের। শেষ তিন বছরে দলের পারফর্ম্যান্স, অভিজ্ঞ-তরুণদের মিশেল, হোম অ্যাডভান্টেজ কিছুটা এগিয়েই রাখবে হ্যারি কেইনের ইংল্যান্ডকে।

এক নজরে

সূচি- প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া, ১৩ জুন; প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড, ১৮ জুন; প্রতিপক্ষ চেক প্রজাতন্ত্র, ২২ জুন।

যেভাবে ইউরোয়- ইউরো বাছাইপর্বের ‘এ’ গ্রুপ থেকে সেরা দল হয়ে মূল পর্বে এসেছে ইংলিশরা।

গত ইউরোয় যেমন খেলেছে- শেষ ষোলো।

সেরা সাফল্য- তৃতীয় স্থান (১৯৬৮, ১৯৯৬)।

ফিফা র‍্যাঙ্কিং- ৪

কোচ- গ্যারেথ সাউথগেট

নজরে রাখবেন যাকে- হ্যারি কেইন তো থাকবেনই। টটেনহ্যাম হটস্পারের হয়ে প্রিমিয়ার লিগে সর্বাধিক গোল (২৩) করেছেন, আবার করিয়েছেনও (১৪)। তবে সদ্যই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে আসা মেসন মাউন্ট ভালোভাবেই থাকবেন ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বে আসরে পাদপ্রদীপ কেড়ে নেওয়ার প্রত্যাশায়, সঙ্গে থাকবেন ম্যানসিটিকে আবারও প্রিমিয়ার লিগ জেতানো ফিল ফোডেনও।

শক্তিমত্তা- ইংলিশদের আক্রমণভাগ তর্কসাপেক্ষে টুর্নামেন্টেরই সেরা। কেইনের সঙ্গে প্রথম একাদশে থাকতে পারেন রাহিম স্টার্লিং আর মার্কাস র‌্যাশফোর্ড। সেটা তো সব দলেরই থাকে! ইংলিশদের আক্রমণভাগকে আর সবার চেয়ে আলাদা করছে তাদের বেঞ্চের শক্তি। নামগুলো দেখুন একবার, ফিল ফোডেন, জ্যাক গ্রেলিশ, ডমিনিক ক্যালভার্ট লিউইন, জ্যাডন স্যাঞ্চো, যারা বদলি হিসেবে নেমেও বদলে দিতে পারেন ম্যাচের গতিপথ। আর তাই কোচ সাউথগেটকে বড় নির্ভরতাই যোগাবে দলটির আক্রমণ।

দুর্বলতা- দলের আক্রমণ আর গোলরক্ষণের পার্থক্যটা যেন এ মেরু-ও মেরুর! আক্রমণভাগে কাকে রেখে কাকে খেলাবেন, এমন মধুর সমস্যা; গোলবারের নিচে নির্ভরতার কি দারুণ অভাব দলটার! জর্ডান পিকফোর্ড তার স্বর্ণসময়কে হারিয়ে খুঁজছেন। আরেক গোলরক্ষক ডিন হেন্ডারসনকে ডাকতে পারেন কোচ সাউথগেট, কিন্তু তাকে প্রথম একাদশে ভেড়ানোর পথে বাধা, তার অভিজ্ঞতার অভাব।

সম্ভাব্য একাদশ-
৩-৪-৩ ছকে;
পিকফোর্ড;
মাগুইয়ার, স্টোনস, ওয়াকার;
শ, মাউন্ট, রাইস, ট্রিপিয়ের;
স্টার্লিং, কেইন, র‍্যাশফোর্ড।

ক্রোয়েশিয়া

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দলটা এবার শিরোপার আশা নিয়ে নামবে না, বিষয়টা হজম করতে হয়তো আপনার কষ্টই হওয়ার কথা। কিন্তু মারিও মানজুকিচ, ইভান রাকিটিচদের বিদায়ে অভিজ্ঞতার অভাব, আর শেষ তিন বছরের পারফর্ম্যান্স জানান দিচ্ছে তাই।

এক নজরে-

সূচি- প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ১৩ জুন; প্রতিপক্ষ চেক প্রজাতন্ত্র, ১৮ জুন; প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড, ২২ জুন।

যেভাবে ইউরোয়- ‘ই’ গ্রুপ থেকে সেরা দল হয়ে ক্রোয়াটরা এসেছে চূড়ান্ত পর্বে।

গত ইউরোতে- শেষ ষোলো।

সেরা সাফল্য- কোয়ার্টার ফাইনাল (১৯৯৬, ২০০৮)।

ফিফা র‍্যাঙ্কিং- ১৪

কোচ- জ্লাৎকো দালিচ

চোখ রাখবেন যার ওপর- লুকা মদ্রিচ যেন ওয়াইনের মতো, বয়স যত যাচ্ছে তত যেন ধার বাড়ছে খেলায়। সদ্যসমাপ্ত ঘরোয়া মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদকে কিছু জেতাতে না পারলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে আলো কেড়েছেন ঠিকই। দেশের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব তার, ঝুলিতে আছে ব্যালন ডি’অরও। ক্রোয়াট মাঝমাঠ তো বটেই, গোটা দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বও বর্তাবে তার অভিজ্ঞ কাঁধেই।

শক্তিসামর্থ্য- নিশ্চিতভাবেই মাঝমাঠ হবে ক্রোয়াটদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। ইভান রাকিটিচ বিদায় বলেছেন জাতীয় দলকে। তবে তার জায়গা ইতোমধ্যেই পূরণ হয়ে গেছে। মাতেও কোভাচিচ, মার্সেলো ব্রজভিচদের সঙ্গে ভ্লাসিচ, মারি পাসালিচরাও কোচ দালিচকে দিতে পারেন নির্ভরতা।

দুর্বলতা- রক্ষণভাগটা কোচ দালিচের বড় চিন্তার জায়গা। নেশনস লিগের ছয় ম্যাচে তার রক্ষণভাগ হজম করেছে মোট ১৬ গোল। সেট পিসে তার রক্ষণ বেশ নড়বড়ে। চোট কাটিয়ে শেষমেশ সিমি ভ্রাসালকো যদি ফিরতে নাই পারেন, তখন ব্যাকলাইন নিয়ে তার দুর্ভাবনা বাড়বে আরও।

সম্ভাব্য একাদশ-
৪-১-২-৩ ছকে;
লিভাকোভিচ;
বেরিসিচ, ভিদা, লভ্রেন, ভ্রাসালকো;
ব্রোজোভিচ;
কোভাচিচ, মদ্রিচ;
রেবিচ, ক্রামারিচ, পেরিসিচ।

চেক প্রজাতন্ত্র

ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে চেকরা। দলটা সেরা সাফল্য পেয়েছিল যেবার, সেই ১৯৯৬ সালে খেলাটা হয়েছিল ইংল্যান্ডেই। এবার প্যান ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টে নিজেদের সব ম্যাচই তারা খেলবে ইংল্যান্ডে। পাকেচক্রে যদি গ্রুপসেরা হয়ে যায়, তাহলে ফাইনাল পর্যন্ত নিজেদের ভেন্যু হবে এই ইংল্যান্ডের মাটিই।

সাম্প্রতিক ইতিহাসও আশাজাগানিয়া দলটির। নেশন্স লিগে স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ডকে দলটা হারিয়েছে বাছাইপর্বে। সেটার পুনরাবৃত্তি যদি এবারও ঘটাতে পারে, তাহলে তো নকআউটের পথটা পরিষ্কার হয়ে যায় অনেকটাই!

এক নজরে

সূচি- ১৪ জুন, প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ড; ১৮ জুন, প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া; ২২ জুন, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড।

যেভাবে ইউরোয়- ‘এ’ গ্রুপের রানার্স আপ হয়ে দলটি এসেছে ইউরোয়, পথে হারিয়েছে ইংল্যান্ডকেও।

গত ইউরোতে- গ্রুপ পর্ব।

সেরা সাফল্য: রানার্স আপ (১৯৯৬)।

কোচ: জারোস্লাভ সিলহাভি।

নজরে রাখুন তাকে- থমাস সুচেক। ফ্যান্টাসি প্রিমিয়ার লিগের মাঝপথে রীতিমতো হটকেক হয়ে উঠেছিলেন তিনি, করেছিলেন ১০ গোল। এই বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার এবার জাতীয় দলের হয়েও পারফর্ম করতে প্রস্তুত। তার উচ্চতা আর মাঝমাঠে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা আর সব মিডফিল্ডার থেকে তাকে আলাদা করে চোখ রাখতে বাধ্য করে।

শক্তি- শারীরিক উচ্চতা দলটিকে খানিকটা ভিন্ন রকমের সুবিধা দেবে। সেটপিস থেকে গোল হজম করার শঙ্কা তো কমাবেই, প্রতিপক্ষ গোলমুখে বাড়তি সুবিধা পেতেও সহায়তা করবে চেকদের।

দুর্বলতা- সেন্টারব্যাক পজিশন। নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্দ্রেজ কুদেলা আর চোট ডেভিড হোভোরকাকে ছিটকে দেওয়ায় দলের মূল ডিফেন্ডার হবেন থমাস কালাস। যিনি ছিলেন ব্রিস্টল সিটিতে, যে দল চ্যাম্পিয়নশিপে শেষ করেছে ১৯ নম্বর দল হিসেবে। দলের গড় উচ্চতা সেটপিস আর বাতাসে আসা বলে দলকে কিছুটা নির্ভরতা দিলেও, অভিজ্ঞদের অনুপস্থিতি সেন্টারব্যাক পজিশনকে করে তুলেছে দলের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা, মাটিতে বল এলে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে দলটিকে।

সম্ভাব্য একাদশ-
৪-২-৩-১ ছকে;
ভাচলিক;
বোরিল, সেলুসৎকা, কালাস, কুফাল;
ক্রাল, সোসেক;
জাঙ্কতো, দারিদা, মাসোপুস্ত;
শিক।

স্কটল্যান্ড

ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া আর স্কটল্যান্ডের গ্রুপে থেকে পরের পর্বে যাওয়াটা কঠিন। তবে স্কটল্যান্ড বাকি তিন প্রতিপক্ষকে হারিয়ে যদি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, তাহলে ডি গ্রুপের দৃশ্যটা দারুণ একটা মোড় নেবে বৈকি!

এক নজরে

সূচি: প্রতিপক্ষ চেক প্রজাতন্ত্র, ১৪ জুন; প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ১৮ জুন; প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া, ২২ জুন।

যেভাবে ইউরোয়- প্লে অফ প্যাথ সি জিতে এসেছে মূল পর্বে।

গত ইউরোয়: খেলতেই পারেনি।

সেরা সাফল্য: গ্রুপ পর্ব (১৯৯২, ১৯৯৬)।

ফিফা র‍্যাঙ্কিং: ৪৪

কোচ: স্টিভ ক্লার্ক

চোখ রাখবেন যার ওপর- অধিনায়ক অ্যান্ড্রু রবার্টসনের ওপর চোখ রাখতেই হবে আপনার। লিভারপুল লেফটব্যাক বর্তমানে বিশ্বেরই সেরাদের একজন। রক্ষণ থেকে আক্রমণে বল যোগান, ক্রসে সতীর্থকে খুঁজে নেওয়ার দারুণ এক ক্ষমতা তাকে দলের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করেছে।

শক্তিমত্তা- দলের লেফট ফ্ল্যাংক। বাঁ প্রান্তে তো রবার্টসন আছেনই, সঙ্গে আছেন আর্সেনাল লেফটব্যাক কিয়েরান টিয়ের্নি। কোচ ক্লার্ক অবশ্য তাকে খেলানোর সম্ভাবনা ওয়াইড মিডফিল্ডার হিসেবেই বেশি, যেহেতু রক্ষণের কাজটা বর্তাবে রবার্টসনের ওপর। দুজনের গতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের লেফট ফ্ল্যাঙ্ক ঘটিয়ে দিতে পারে অঘটনও।

দুর্বলতা- আক্রমণভাগ। দলের রক্ষণভাগ আর আক্রমণ বেশ পোক্ত, কিন্তু প্রতিপক্ষ গোলমুখে কিছুটা দুর্বল কোচ ক্লার্কের দল। তাই রবার্টসন-টিয়ের্নির বাড়ানো বলগুলো কাজে লাগানোর মতো খেলোয়াড় আছে কিনা দলে, তা নিয়েও রয়ে যায় প্রশ্ন।

সম্ভাব্য একাদশ-
৪-৩-৩ ছকে;
মার্শাল;
রবার্টসন, কুপার, ম্যাকটমিনি, ও’ডনেল;
টিয়েরনি, ম্যাকগিন, ম্যাকগ্রেগর;
ফ্রেসার, অ্যাডামস, ক্রিস্টি।

এনইউ/এটি