তারুণ্যকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। এর উজ্জ্বল উদাহরণ মালদ্বীপের কিংবদন্তি ফুটবলার আলী আশফাক। ৩৬ বছর বয়সেও দুর্বার। গত দুই ম্যাচে একটি করে গোল করেছেন। ২২ গোল করে সাফের আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একমাত্র জয়সূচক গোলের পর আলী আশফাক ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরের সঙ্গে কথা বলেছেন নিজের ক্যারিয়ার, মালদ্বীপ ও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। 

প্রশ্ন: সাফের আসর মানেই আলী আশফাকের গোলের পর গোল। ৩৬ বছর বয়সেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ক্রমাগত এই সাফল্যের ধারাবাহিকতার রহস্য কী?

আশফাক: প্রথমে আল্লাহকে শুকরিয়া এখনো আমাকে সুস্থ ও ফিট রেখেছেন। এরপর ধন্যবাদ সতীর্থদের যাদের কারণে আমার সকল গোলের উৎস। আমি শুধু গোলের চেষ্টাটা করি। অনেক ক্ষেত্রে সফল হই, আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ। ব্যর্থ হলেও চেষ্টা করে যাই। গোল করার ক্ষুধা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। এখনোও সেই ক্ষুধাই রয়েছে। যতদিন ফুটবল খেলব সেই গোলের ক্ষুধা থাকবে।

প্রশ্ন: কতোদিন ফুটবল খেলবেন এই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার অবসর পরিকল্পনাটা কী?

আশফাক: আমি নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাই। মাঝে অবসর নেয়ার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু মালদ্বীপের ফুটবলের বন্ধু,সতীর্থরা আমাকে ছাড়তে দেয়নি। তাদের অনুরোধে খেলেই যাচ্ছি জাতীয় দল ও ক্লাবে। অবসরের সিদ্ধান্তটাও তাদের উপরই অনেকটা। আমি এখনো ফুটবলকে দারুণ উপভোগ করছি।

প্রশ্ন: অবসর না হয় পরে নিলেন সবার সঙ্গে আলোচনা করেই। অবসরের পর ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা করে রেখেছেন?

আশফাক: হ্যাঁ সেটা করা আছে। আমি কোচিংয়ে আসব না এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সুযোগ পেলে আমি জাতীয় দলের ম্যানেজার হতে চাই। এছাড়া আমার নিজেরই প্রথম বিভাগের দল রয়েছে। সেই দলে আরো সময় দেব। 

প্রশ্ন: ম্যানেজার হওয়ার বিশেষ কারণ কি?

আশফাক: আমি ফুটবলারদের অধিকারে কাজ করতে চাই। জাতীয় দলের ম্যানেজারই আমার জন্য সেরা পদ বলে মনে করি। ম্যানেজার হলে আমি ফুটবলারদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারব। এখন আমাদের ফুটবলাররা কোনো টুর্নামেন্টের জন্য মাত্র ১০০ ডলার পায়। এটা আমি ম্যানেজার হলে অবশ্যই বাড়ানোর চেষ্টা করব। ২০১৮ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এরপরও তেমন বোনাস পায়নি ফুটবলাররা। ওরা কিছু বলতে পারেনি এই নিয়ে। আমি থাকলে অবশ্যই ফেডারেশনকে এই বিষয়ে কিছু বলতাম। 

প্রশ্ন: ফুটবলারদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে চান এজন্য ম্যানেজার হতে চান। ফেডারেশনের সভাপতি হলে পুরো দেশের ফুটবল নিয়েই কাজ করতে পারবেন। আপনাদের দেশের সভাপতি সাবেক ফুটবলার, বাংলাদেশেরও... 

আশফাক: না ওসব পদ আমার জন্য না। আমার পদের প্রতি কোনো আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা নেই। আমি খুব সাধারণভাবে ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চাই।

প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় মালদ্বীপেই কাটালেন। দেশের বাইরে খুব একটা খেললেন না। আপনার যে কোয়ালিটি তাতে ইউরোপ অথবা এশিয়ার শীর্ষ লিগে খেলতে পারতেন।

আশফাক: আমি দুই-তিন মৌসুমে ব্রুনাই, মালয়েশিয়ার লিগ খেলেছি। তবে মালদ্বীপে খেলেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য পাই। এজন্য মালদ্বীপেই খেলি।

প্রশ্ন: মালদ্বীপের ফুটবলে খুব বেশি অর্থ নেই। আপনার মান অনুযায়ী বাইরের লিগে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পেতেন...

আশফাক: আসলে মালদ্বীপে আমাদের ফুটবল এখনো পেশাদার না। অর্ধেক পেশাদার ভাবে চলছে। অনেক ফুটবলার খেলার পাশাপাশি চাকরি, ব্যবসা করে। আমিও নিজেও আট বছর চাকরি করেছি। আমাকে অর্থ খুব বেশি টানে না। মালদ্বীপে আমি যা পাই তাতেই খুশি আলহামদুলিল্লাহ। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলে অনেক অর্থ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে। বাংলাদেশে খেলার কোনো প্রস্তাব পাননি কখনো?

আশফাক: বসুন্ধরার কোচ অস্কার আমাকে বসুন্ধরা কিংসে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল, আমি যাইনি। অস্কারই শুধু আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ক্লাব কখনো আমাকে সেভাবে প্রস্তাব দেয়নি।

প্রশ্ন: আপনি তো পর্তুগালের বেনফিকার প্রস্তাবেও সাড়া দেননি। তরুণ বয়সে বেনফিকায় গেলে আপনার ক্যারিয়ার আরো ভিন্ন মাত্রা পেত নিশ্চয়ই। কেন গেলেন না বেনফিকায়?

আশফাক: সেটা অনেক বড় কাহিনী। আজ সেই কাহিনী বলার মতো নয়। সেখানে গেলে অনেক কিছু হতে পারতো আবার নাও পারতো। এখন যেই অবস্থায় আছি আলহামদুল্লিাহ। বেনফিকা না যাওয়ার বা না যেতে পারার অনেক বিষয় ছিল। একটি বলি শুধু আমি পরিবার ও দেশে থাকতে চেয়েছিলাম।

প্রশ্ন: অস্কার আপনার নিউ রেডিয়েন্টের কোচ ছিলেন। বসুন্ধরায় অনেক অর্থ এরপরও গেলেন না কেন?

আশফাক: আগেই বলেছি অর্থ আমাকে সেভাবে টানে না। বাংলাদেশে না যাওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত আমি পরিবারের সাথে থাকতে চাই, দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ অনেক জনবহুল এবং ঢাকা জ্যামের শহর। সব মিলিয়ে অস্কারের প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারিনি। আমি জানি বসুন্ধরায় অনেক অর্থ। এএফসি কাপে খেলতে আসা প্রতি খেলোয়াড়কে অনেক বোনাস দিয়েছে যা আমাদের ক্লাব ও জাতীয় দল কোথাও দেয়া হয় না।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ফুটবলে অনেক অর্থ, জনবল, কাঠামো রয়েছে এরপরও আপনাদের পেছনে বিষয়টি কিভাবে দেখেন?

আশফাক: বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের খেলা একটু কমই হয়। তারপরও আমার দৃষ্টিতে অস্কারের এই বাংলাদেশকে ভালোই লাগছে। আমি অনেক কোচের অধীনে খেলেছি। এর মধ্যে অস্কার আমার প্রিয়দের একজন। সে বন্ধুর মতো শিক্ষক। খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করে সেরাটা আনতে পারে।

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় ফুটবলার কে?

আশফাক: দেশে না আন্তর্জাতিকভাবে?

প্রশ্ন: দুটো মিলিয়ে

আশফাক: দেশে আলী উমর। যিনি এখন ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আর আন্তর্জাতিকভাবে মেসি। 

প্রশ্ন: আপনাকে তো দক্ষিণ এশিয়ার মেসি বলা হয়। মেসিকে পছন্দ করেন বলেই কি মেসি ডাকা হয় আপনাকে?

আশফাক: হয়তো বা আবার নাও। তবে আমার মনে হয় আমি বা পায়ের সেও বা পায়ে দারুণ এজন্য হয়তো লোকজন ও মিডিয়া মেসি বলে। মালদ্বীপের অধিনায়ক ছিলাম অনেক দিন। ব্যালন ডি’অর ফিফায় অধিনায়করা ভোট দেয়। আমি কিন্তু রোনালদোকেও ভোট দিয়েছি। ভক্ত হলেও বছরের পারফরম্যান্স বিবেচনায় আমি মেসির পাশাপাশি রোনালদোকেও ভোট দেই।

প্রশ্ন: সাফে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা আপনি। আপনার কোয়ালিটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা। এরপরও কি মনে হয় আপনার চেয়ে ভারতের সুনীল ছেত্রী একটু বেশি আলোচিত আপনার চেয়ে? 

আশফাক: এটি নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। সেও দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব। মালদ্বীপের প্রতিটি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। একদম ছোট্ট বাচ্চা থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত। এটাই আমার বড় পাওয়া। আমি দেশের জন্য খেলি দেশকে কিছু দিতে পারি। এখানেই আমার বড় তৃপ্তি। তবে একটু অতৃপ্তির জায়গা রয়েছে সেটা হলো আমরা যদি বেশি বেশি প্রীতি ম্যাচ খেলতে পারতাম তাহলে হয়তো আমার আন্তর্জাতিক গোল আরো অনেক বেশি হতো। তারপরও যা হয়েছে আলহামদুল্লিাহ।

প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত কোনটি।

আশফাক: ২০০৮ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। 

প্রশ্ন: আর দুঃখজনক?

আশফাক: প্রতিটি ম্যাচ হারাই দুঃখজনক। এমনকি আমি যখন দুই দলে ভাগ হয়ে অনুশীলন করি সেখানেও হারলে খুব কষ্ট পাই।

প্রশ্ন: এবারের সাফটি কেমন হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে গত দশ বছরের তুলনায় এখন কেমন?

আশফাক: বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চার দলেরই সম্ভাবনা আছে ফাইনাল খেলার। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল নিঃসন্দেহে এগিয়েছে। আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নেপাল, ভূটান সেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতো না। এখন তারা যথেষ্ট উন্নতি করেছে। 

প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ারের কথা বললেন, মালদ্বীপের ফুটবলে আপনার আসার পরই মূলত নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। আপনার অবসরের পর কি কেউ সেটা পূরণ করতে পারবে?

আশফাক: অবশ্যই পারবে। আরো অনেক আশফাক আসবে মালদ্বীপের ফুটবলে। অনেক মেধাবী ফুটবলার উঠে আসছে তারা মালদ্বীপকে আরো ভালো কিছু দেবে।

প্রশ্ন: মুসা মানিককে বলা হয় মালদ্বীপের অন্যতম সেরা ফুটবলার। আপনার কি মনে হয় জনপ্রিয়তায় ও পারফরম্যান্সে আপনি তাকে ছাড়িয়ে গেছেন?

আশফাক: সে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তার বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য করা ঠিক হয় না। আমি আমার সেরাটা দিয়ে দেশকে কিছু করার চেষ্টা করেছি। 

প্রশ্ন: সাফ টুর্নামেন্ট চলছে সাফ দিয়েই শেষ করি। মালদ্বীপ প্রথমবারের মতো একক আয়োজক। আপনার ক্যারিয়ার শেষের দিকে। ঘরের মাঠে সাফ জয় আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় হবে নিশ্চয়ই।

আশফাক: সেটা স্মরণীয় ঘটনা হবে। তবে সবচেয়ে সুখের স্মৃতি প্রথম শিরোপাই। কারণ প্রথম যে কোনো কিছুই দারুণ। আমার তিন সন্তান। প্রথম বাবা হওয়ার স্বাদটাই সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০০৮ শিরোপা জয়ই আমার কাছে ক্যারিয়ারের সেরা মুহুর্ত। 

প্রশ্ন: পরিবারের কথা আনলেন। দুটি বিষয় জানতে চাই। আপনার তিন সন্তান। কাউকে ফুটবলার বানাতে চান কিনা। আর আপনার বিয়ে কি প্রেমের?

আশফাক: সন্তানরা যদি ফুটবলার হতে চায় অবশ্যই স্বাগত। আমার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই । তারা যেটা হতে চায় বা তাদের যা ভালো লাগে তাই হবে। হ্যাঁ অবশ্যই আমার বিয়ে প্রেম করে। মালদ্বীপে অধিকাংশ বিয়েই প্রেমের। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশে আপনার অনেক ভক্ত। তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন...

আশফাক: আমার অনেক সমর্থক রয়েছে বাংলাদেশে এটা আমি জানি। ফুটবল খেলতে অনেক দেশেই গিয়েছি। তবে বাংলাদেশে সমর্থন একটু বেশি পেয়েছি। মালদ্বীপেও বাংলাদেশি মানুষ অনেক। বাংলাদেশকে আমি সব সময় ভালোবাসি। বাংলাদেশ ফুটবলে ভালো করছে, ভালো করবে। সবাই বাংলাদেশ ও মালদ্বীপকে সমর্থন করবেন। 

প্রশ্ন: আমি বাংলাদেশি সাংবাদিক বলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমর্থন পান বললেন..

আশফাক: না, না। আসলেই বাংলাদেশে আমি অনেক সমর্থন পাই। এমনকি মালদ্বীপে অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী আমাকে অনেক ভালোবাসে ও পছন্দ করে। তারাও আমার অনেক ভক্ত। 

এজেড/এটি/টিআইএস