প্রথমবারের মতো মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার ‘বিশ্বকাপ’ সাফের আয়োজক হয়েছে। আজ (শনিবার) পর্দা নামছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। মালদ্বীপ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিত্বে রয়েছেন মাত্র ৩৮ বছর বয়স্ক বাসাম আদিল জলিল। তার সভাপতিত্বের সময় মালদ্বীপ ২০১৮ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

এবার বাসাম নিজ দেশকে করেছে সাফের আয়োজক। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বকনিষ্ঠ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসামের সঙ্গে মালদ্বীপ ও দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের। 

ঢাকা পোস্ট : মালদ্বীপ সাফ ফুটবলে এককভাবে স্বাগতিক হবে এটা অনেকেই ভাবেনি। আপনি এবং আপনার ফেডারেশন হঠাৎ সাফ আয়োজনে আগ্রহী হয়েছিলেন কেন?

বাসাম: বাংলাদেশে এবার এই টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশে যখন হলো না। তখন আয়োজক পাওয়া যাচ্ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের করোনা আক্রান্তের হার কম। পাশাপাশি জনসংখ্যা কম হওয়ায় ভ্যাক্সিনেশনের হার সবচেয়ে বেশি। এজন্য আমরা আয়োজক হতে আগ্রহী হই। মালদ্বীপের জনগণ সবাই ফুটবলপ্রেমী। তারাও দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ নিজ শহরে দেখার সুযোগ পেল। 

ঢাকা পোস্ট : ফেডারেশনের পাশাপাশি আপনার দেশের সরকারও এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের ব্যাপারে খুব আন্তরিক ছিল। সেটাও কি স্বাগতিক হিসেবে বিড করার আরেকটি কারণ ছিল? 

বাসাম: সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই টুর্নামেন্টের আয়োজক হওয়া সম্ভব ছিল না। মালদ্বীপ পর্যটনের দেশ। করোনা পরবর্তী সময়ে সাফ ফুটবলের মাধ্যমে পর্যটনের জন্য মালদ্বীপ প্রস্তুত সেটাও আমাদের রাষ্ট্রের একটা বিষয় ছিল। ফুটবলের পাশাপাশি এটিও অন্যতম একটি কারণ বলা যেতে পারে। 

ঢাকা পোস্ট : আপনি তো ফুটবলার ছিলেন। ফুটবলার থেকে হঠাৎ দেশের ফুটবলের শীর্ষ পদে আসলেন কীভাবে?

বাসাম : ফুটবল আমি খুব উপভোগ করি। আমার বাবা একজন ফুটবল সংগঠক। দেশের অন্যতম শীর্ষ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার দীর্ঘদিনের সভাপতি। বাবার কাছ থেকেই ফুটবল প্রশাসনের ধারণা। পরবর্তীতে পর্যায়ে সবার অনুরোধে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়া। 

ঢাকা পোস্ট : আপনার সময়ে মালদ্বীপের দু’টি সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় ক্লাব রেডিয়েন্ট ও ভিক্টোরি ফুটবল থেকে বহিষ্কৃত। তাদের না থাকাটা মালদ্বীপের ফুটবলের জন্য কতটুকু প্রভাব পড়ছে এবং রেডিয়েন্টের কর্মকর্তাদের দাবি অ্যাসোসিয়েশন তাদের অনেকটা একপাক্ষিকভাবেই বহিষ্কার করেছে...

বাসাম : পরের অংশের উত্তর আগে দিচ্ছি। নিয়ম সব ক্লাবের জন্য সমান। আমরা যা করেছি নিয়মের মধ্যে থেকেই করেছি। আমাদের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কিন্তু ফিফাও তাদের ট্রান্সফার ব্যান করেছে। এখানে আমাদের কোনো পক্ষপাত ছিল না। মালদ্বীপের ফুটবলের স্বার্থে আমাদের নিয়ম মেনেই চলতে হয়েছে। তাদের ফুটবলে না থাকাটা অবশ্যই প্রভাব পড়ছে। তারা অনেক জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এই দুই ক্লাব না থাকায় গ্যালারিতে দর্শক সংখ্যা কমেছে। লিগের প্রাণই হচ্ছে দর্শক। 

ঢাকা পোস্ট : মালদ্বীপের ফুটবলে অন্যতম সমস্যা মাঠ সংকট। ক্লাবগুলো অর্ধেক টার্ফে অনুশীলন করে। এই সংকট দূর করতে অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা কী?

বাসাম: মাঠের এই সংকট সমাধানে আমার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছেছি। সরকার এই ব্যাপারে আন্তরিক ভূমিকা রেখেছে। দেশের অনেক জায়গায় স্টেডিয়াম ও মাঠ হচ্ছে। ২০২২-২৩ সাল থেকে মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবল হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে খেলা যাবে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ক্লাবগুলোকে আর অর্ধেক টার্ফে অনুশীলন করতে হবে না। দ্বিতীয় মেয়াদে আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি তখন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ছিল ক্লাবগুলোকে পেশাদার মডেলে আনা এবং খেলাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা। ক্লাবগুলোকে আগের চেয়ে অনেক আর্থিক সাহায্য দিচ্ছি। দুই-তিন বছর পর আশা করি তারা নিজেরাই সাবলম্বী হতে পারবে। 

ঢাকা পোস্ট : আপনার নির্বাচনী ইশতেহার ঘরোয়া ফুটবলের প্রতিশ্রুতি ছিল। জাতীয় দল নিয়ে আপনার প্রতিশ্রুতি ছিল না কোন?

বাসাম: অবশ্যই আছে। যদিও এখন সাফ টুর্নামেন্ট চলছে তারপরও বলব আমাদের লক্ষ্য এশিয়া কাপ খেলা। মালদ্বীপ এশিয়া কাপে খেলবে এটা আমাদের সবার চাওয়া। সেটা খুব বেশি অসম্ভব না। র‌্যাঙ্কিং যদিও আমরা কিছুটা পিছিয়ে। আমরা এখন ২৪ দলের বাছাইয়ে রয়েছি। ২৪ দলের মধ্য থেকে ১২’তে জায়গা করে নেওয়ার যোগ্যতা আমাদের আছে। এজন্য আমরা পরিশ্রম ও পরিকল্পনা করছি। 

ঢাকা পোস্ট : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য বাংলাদেশ ও ভারতই এশিয়া কাপের মূল পর্বে খেলেছে। মালদ্বীপ কি তৃতীয় দেশ হতে পারবে?
 
বাসাম: অবশ্যই পারবে। মালদ্বীপে মেধাবী ফুটবলার অনেক। তারা দেশের জন্য নিজের সেরাটাই দেয়। মেধাবী ফুটবলারদের সার্বক্ষণিক ফুটবলে রাখাই আমার ও আমার অ্যাসোসিয়েশনের চ্যালেঞ্জ। এখনো অনেক ফুটবলার ফুটবলের পাশাপাশি জীবিকার জন্য অন্য চাকরি করে। সেই চাকরি থেকে ফুটবলে পুরো সময় আনতে পারলে আমার অনেক দূর যাব। সেই লক্ষ্যে আমি কাজ করছি। আমাদের ফুটবলে মেধা রয়েছে। এই মেধাবী ফুটবলারদের সার্বক্ষণিক ফুটবলে রাখতে পারলে এশিয়া কাপ খেলতে পারা কঠিন কিছু না। 

ঢাকা পোস্ট : আশফাক, আলী ফাসির, আকরামের মতো ফুটবলার আর বেশি দিন খেলতে পারবে না...

বাসাম: তারা নিঃসন্দেহে দেশের ফুটবলের কিংবদন্তি। তবে আমাদের তৃপ্তির জায়গা হচ্ছে তাদের শূন্যস্থান পূরণে খুব বেশি সময় লাগবে না। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেই দলের গড় বয়স ২৩। ফলে সেই দলটি এখন ২৬-২৭ বছর গড় বয়স। আমাদের পাইপলাইনে অনেক খেলোয়াড় রয়েছে। যারা বিভিন্ন ক্লাবে প্রস্তুত হচ্ছে দেশের জার্সি পরার জন্য।  

ঢাকা পোস্ট : ২০১৯ সাল থেকে ২৪ দলের এশিয়া কাপ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্ভাবনা বেড়েছে। এশিয়া কাপ খেলা আপনাদের স্বপ্ন। বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে আপনাদের স্বপ্ন কী?  

বাসাম: বিশ্বকাপ অনেক দূরের বিষয়। আমরা সেটা নিয়ে এখনো ভাবছি না। আমাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য এশিয়া কাপ খেলা। এশিয়া কাপ নিয়মিতভাবে খেলতে পারলে এরপর বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবা যাবে।

ঢাকা পোস্ট : আপনি দ্বিতীয় মেয়াদে দ্বিতীয় বছর পার করছেন। ক্লাবগুলো অধিকাংশ আপনার সমর্থক। তৃতীয় মেয়াদে আবার সভাপতি পদে দাঁড়াবেন?

বাসাম: এখন মাত্র দ্বিতীয় বছর চলছে। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিক খেলা, ক্লাবগুলোকে ব্যবসায়িক মডেল এবং এশিয়া এই তিনটি কাজের অন্তত দু’টো করতে পারলে নির্বাচন করব। আমার প্রতিশ্রুতির অন্তত ৫০% পূরণ করতে চাই। 

ঢাকা পোস্ট : আপনার বয়স ৪০ এর কম। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি আপনি। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সভাপতিই সাফ, এএফসির অনেক পদে রয়েছে। সামনে সাফ নির্বাচন । কোনো পদে নির্বাচন করবেন?

বাসাম : সাফ, এএফসি, ফিফা কোনো সংগঠনের কোনো পদে আমার আগ্রহ নেই। আগামী দুই বছর মালদ্বীপের ফুটবল নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করতে চাই। এই দুই বছর যদি ভালো কিছু করতে পারি যদি সবাই চায় তাহলে আরও একবার কাজ করার ইচ্ছে আছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন নিয়ে আমার এখন কোনো ভাবনা বা ইচ্ছে নেই।

ঢাকা পোস্ট : ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে সাফ আয়োজন আপনার অন্যতম বড় অর্জন। এ রকম আয়োজন নিয়মিত করবেন কি না...

বাসাম: অবশ্যই করব। সাফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি বলেছি জুনিয়র পর্যায়ের টুর্নামেন্টের স্বাগতিক হতে চাই আমরা। আয়োজনের এই ধারবাহিকতা বজায় রাখতে চাই। 

ঢাকা পোস্ট : আয়োজক হলে অনেক সময় আর্থিক লাভও হয় অ্যাসোসিয়েশনের। এই সাফ থেকে কেমন লাভ হতে পারে মালদ্বীপ ফুটবল এসোসিয়েশনের... 

বাসাম : আমাদের লাভ হবে না বললেই চলে। আয় ব্যয় সমান সমান থাকবে। এতেই আমরা খুশি। করোনাকালীন সময় টুর্নামেন্টের আয়োজন করাটাই চ্যালেঞ্জ ছিল। সরকার ও পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ তাদের সহযোগিতার জন্য। মালদ্বীপে হোটেল ব্যয় অনেক বেশি। যেটা হয়তো আপনারা সাংবাদিকরাও টের পাচ্ছেন। হোটেল খরচ আমাদের অনেক চলে যাচ্ছে। 

ঢাকা পোস্ট : মালদ্বীপ ফুটবল এসোসিয়েশনের বাজেট ও আয়-ব্যয়ের খাত সম্পর্কে যদি একটু ধারণা দিতেন...

বাসাম: আমাদের বার্ষিক বাজেট ১০০ মিলিয়ন মালদ্বীপ রুপি। এই বাজেটের চেয়ে চার-পাঁচ মিলিয়ন বেশিও খরচ হয় অনেক সময়। আমাদের আয়ের উৎসের মধ্যে ফিফা ও এএফসির অনুদান ৬০ ভাগ। ৩০ ভাগ স্পন্সর আর দশভাগ সরকার। আমাদের বাজেটের ব্যয়ের ৩০ ভাগ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো, বিশ ভাগ ইয়ুথ ডেভলপমেন্ট, বাকি ৫০ ভাগ প্রশাসনিক ব্যয়, খেলা পরিচালনা করা ইত্যাদি।

ঢাকা পোস্ট : শুনেছি বর্তমান রাষ্ট্রপতি আপনার ঘনিষ্ঠ। মালদ্বীপের ফুটবল উন্নয়নের জন্য সরকারের সাহায্য আরও বেশি পান নিশ্চয়ই?

বাসাম : রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত ফুটবলপ্রেমী। মালদ্বীপের তিন ম্যাচের মধ্যে দু’টো খেলায় এসেছিলেন। এই টুর্নামেন্ট হচ্ছে এখানেও তার ভূমিকা রয়েছে। মালদ্বীপের ফুটবল উন্নয়নের জন্য তিনি সব সময় আমাদের পাশেই থাকবেন।

ঢাকা পোস্ট : অনেক মুসলিম দেশ নারী ফুটবলও এগিয়ে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারী ফুটবলে মালদ্বীপ কিছুটা পিছিয়ে। নারী ফুটবল নিয়ে পরিকল্পনা কী?

বাসাম : আমরা নারী ফুটবল নিয়েও কাজ করছি। অনেক অভিভাবকই মেয়েদের এখনো ফুটবলে দিতে চান না। আমরা সামাজিক এই বিষয়গুলো নিয়েও কাজ করছি।  

ঢাকা পোস্ট : প্রশাসনিক সর্বোচ্চ পদে একজন সাবেক ফুটবলার না একজন জাত সংগঠক। কে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রশ্নটি দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বেশ প্রচলিত। আপনি কী মনে করেন?

বাসাম : একজন সাবেক ফুটবলারও সভাপতি হতে পারে তাতে সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে তার অবশ্যই সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক জ্ঞান থাকতে হবে। এই দু’টি থাকলে ফুটবলারের টেকনিক্যাল অভিজ্ঞতা অনেক সময় অ্যাসোসিয়েশন পরিচালনা করতে সহায়ক হয়। আমি বিষয়টি এভাবেই দেখি।

এজেড/এটি/এমএইচ