হারুনকে ঘিরেই বাংলাদেশের দাবা
দাবা টুর্নামেন্ট পরিচালনা করছেন, দিনের খেলা শেষে আবার প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন এর মধ্যে আবার বিশ্ব ও এশিয়ান দাবা ফেডারেশনের সঙ্গেও দাপ্তরিক যোগাযোগ রাখছেন; হারুনুর রশীদের কর্মব্যস্ততা এ রকমই। গত তিন দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের দাবা ও হারুন একে-অন্যের পরিপূরক। দাবা ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও দাবার বিচারক দুই দায়িত্বেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশেষ উচ্চতায়।
১৯৮০ সালে দাবা খেলতেই দাবা অঙ্গনে আসা হারুনের। দাবাড়ু হিসেবে পথচলাটা বেশি দিন হয়নি। চার বছরের মধ্যেই দাবার অন্য চরিত্রে নিজের নাম লেখান। ১৯৮৪ সাল থেকে আরবিটার (বিচারক) হিসেবে যাত্রা শুরু করেন৷ বাংলাদেশে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির মতো দলীয় খেলায় আম্পায়ারিং বা বিচারকের কাজটা অনেকটা ‘থ্যাঙ্কসলেস’ হলেও বুদ্ধির খেলা দাবায় সেই রকম নয়।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের দাবায় বিচারক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক এ আর খানের মতো ব্যক্তিত্বও। তাকে দেখে হারুন, আলমাসরা বিচারক হিসেবে পথচলা শুরু করেন। এই পথে অনেকে ছিটকে পড়েছেন আবার অনেকে আগ্রহ হারিয়ে অন্য পেশায় গেলেও হারুন ছিলেন অবিচল। তাই হারুন দিনে দিনে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ হারুনের বিশ্ব অঙ্গনের পরিচিতি সম্পর্কে বলেন, ‘দাবার আইন-কানুন সম্পর্কে তার অগাধ দখল। ফিদের অনেক শীর্ষ পর্যায়ের বিচারক তার মতামত নেন অনেক সময়। আমরা দেশের বাইরে অনেক টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে জিজ্ঞেস করে হারুন আসেনি? এশিয়া তো বটেই বিশ্ব দাবায় হারুন ভাই নিজেকে বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এটা আমাদের জন্য গর্বের।’
বিজ্ঞাপন
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে (অ-১৯, নারী) বাংলাদেশের দুই আম্পায়ার সৈকত ও মুকুল আম্পায়ারিং করছেন সাম্প্রতিক সময়ে। সেখানে হারুনের বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে হারুনের উপস্থিতি ছয়বার আর বিশ্বকাপে একবার। এশিয়ার চিফ আরবিটার ছিলেন যথাক্রমে ২০১৫ ও ১৯ সালে।
পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের মধ্যে জিয়াউর রহমান দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। হারুনের দক্ষতা তার চোখে ধরা পড়েছে বিশেষভাবে, ‘এখন অনেক কিছুই অনলাইন নির্ভর। সে এতে খুবই দক্ষ এবং দ্রুত ফলাফল দিতে পারে অন্য অনেক আরবিটারের তুলনায়।’
বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব হারুনের আরেকটি গুণের মুগ্ধ বিশেষভাবে, ‘অনেক সময় আমার নিজের রেকর্ড বা ফলাফল সঠিকভাবে মনে থাকে না। হারুন ভাইকে জিজ্ঞেস করলে নির্ভুলভাবে বলে দেন। কোন সালে কে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিয়াড বিশ্বকাপে কে কতবার গিয়েছে কি ফলাফল সবই তার আত্মস্থ।’ হারুনের এই বিশেষ সক্ষমতার জন্য তাকে অনেকে দাবার এনসাইক্লোপিডিয়া বা দাবা কোষও বলেন।
১৯৯৪ সালে বিচারকের পাশাপাশি ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন ( ২০১১-১২ দেড় বছর ছিলেন না প্রশাসনিক দায়িত্বে)। প্রশাসনিক দায়িত্ব নেয়ার ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তখন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকই প্রশাসনিক কাজ করতেন। স্থায়ী কেউ ছিল না। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মজিবুর সাহেব আমাকে ফেডারেশনে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সব সময় টুর্নামেন্ট পরিচালনা করি দাবা ফেডারেশনে আসতেই হয় এজন্য দায়িত্ব নিয়ে নিলাম।’ এরপর থেকে ফেডারেশনের প্রশাসনিক সব কিছুই তিনি দেখভাল করেন।
ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলার খেলোয়াড়রাই আর্থিকভাবে সাবলম্বী নন। সেখানে বিচারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আর্থিক সাবলম্বীতা তেমন থাকে না। হারুন নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে আর্থিক প্রতিবন্ধকতাও দূর করেছেন। ফেডারেশন থেকে মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সম্মানী পান প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। টুর্নামেন্টের চিফ আরবিটার হিসেবেও থাকে বিশেষ ভাতা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোর সম্মানীর হার একটু বেশি।
অন্য পেশায় ক্যারিয়ার না গড়ে দাবাতেই জীবন কাটিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে হারুন বলেন, ‘দাবাতেই থাকব আজীবন এটা লক্ষ্য ছিল না। দাবা উপভোগ করেছি। এভাবে চলছে। যখন মনে হলো দাবাতেই থেকে গেলাম, তখন আর অন্য পেশা বা অন্য কিছু করার সময় ছিল না।’
হারুনের প্রতি দাবাড়ু ও দাবা ফেডারেশনের নির্ভরশীলতা অনেক। এই নির্ভরতা প্রমাণ করে হারুনের অনন্য যোগ্যতা-দক্ষতা, আবার অন্য দিকে একটি খেলা একজন ব্যক্তির উপর অতিমাত্রায় নির্ভর কোনো বিকল্প নেই সেটাও নির্দেশ করে। হারুনের যোগ্য বিকল্প না হলেও তার উত্তরসুরি তৈরির চেষ্টা ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীমের, ‘যেকোনো কাজ তার উপর ভরসা করা যায়। সে সব কাজেই দক্ষ। তার উপর একক চাপ দুর করতে আমরা নতুন আরবিটার তৈরি করছি। নতুনরাও দক্ষতার সাথে খেলা পরিচালনা করছে। প্রশাসনিক কাজও নতুনদের পরিচর্যা হচ্ছে।’
হারুনের বিকল্প সম্ভব না বলে মনে করেন প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, ‘হারুন ভাই বিচারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যে পর্যায়ে পৌছেছেন সেই পর্যায়ে কেউ সহসাই যেতে পারবে না।’
এজেড/এমএইচ