অন্য দশটি দিনের চেয়ে আজকের দিনটি শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়াম ছিল একটু ভিন্ন। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা নিজেদের প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে আজকের দিনটি মেতে উঠেছিলেন ব্যাডমিন্টন আনন্দে। হুইল চেয়ার নিয়ে এক কোর্ট লড়ছেন কয়েকজন, কয়েক গজ দূরে পাশের কোর্ট এক হাতে স্ট্রেচার ও এক হাতে র‌্যাকেট নিয়ে খেলে যাচ্ছেন অনেকে। 

ঢাকার অদূরেই চিটাগাং রোড থেকে এসেছেন একই পরিবারের তিনজন। বাবা আব্দুল আওয়াল, ছেলে ইয়ামিন ও মেয়ের স্বামী আশরাফ আলী। তিনজনই খর্বাকৃতির, এরপরও ব্যাডমিন্টনের টানে ছুটে এসেছেন তারা। ৫০ বছর বয়সী আওয়াল ছোট ছেলে ও মেয়ের স্বামীকে নিয়ে আসতে পেরে উচ্ছ্বাসিত।

তিনি বলেন,  ‘আমাদের পরিবার খেলাধুলা পছন্দ করে। আমার স্ত্রীও এসেছে সাথে। বছরে দুয়েকটি দিন এরকম আনন্দে কাটাতে পারলে ভালোই লাগে।’ আওয়ালের ২০ বছর বয়সী ছেলে ইয়ামিনের প্রতিক্রিয়া,‘ বাবার সাথে এক সাথে চায়ের দোকানে কাজ করি। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু দিন ব্যাডমিন্টন খেলি। আমি এখানে আসি মাঝে মধ্যে। বাবা, দুলাভাই,মা’কে নিয়ে আসার উপলক্ষ্য হয় কয়েক বছর পর পর।’

খর্বাকৃতি হলেও ব্যাডমিন্টন নিয়ে স্বপ্নের জাল অনেক বড় ইয়ামিনের, ‘ব্যাডমিন্টন আমার খুব পছন্দের খেলা। এনায়েত ভাই (কোচ, সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন) আমাকে অনুশীলন করান মাঝেমধ্যে। আমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন দেখি।’ 

সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও বর্তমানে কোচ এনায়েত উল্লাহ খান প্যারা ব্যাডমিন্টন কমিটির সভাপতি। ইয়ামিনের স্বপ্ন দেখাকে বাস্তবসম্মতই মনে করছেন তিনি, ‘প্যারা ব্যাডমিন্টনে ছয়টি ক্যাটাগরি। এর মধ্যে তিনটি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্যারা অলিম্পিক বা প্যারা ব্যাডমিন্টনের বড় আসরগুলোতে ভালো কিছু করা সম্ভব। বিশেষ করে ইয়ামিনদের (খবাকৃতি ক্যাটাগরির) ইভেন্টে সবচেয়ে বেশি সম্ভব।’ 

সাধারণ ব্যাডমিন্টন থেকে হুইলচেয়ার ও স্ট্রেচার ব্যাডমিন্টনের নিয়মে কিছুটা পার্থক্য আছে। হুইলচেয়ার ও স্ট্রেচার দুই ক্যাটাগরিতেই একটি কোর্টের ওপর শাটল রাখতে হয়। হুইল চেয়ারের ক্ষেত্রে কোর্টের সামনে শাটল পড়লে পয়েন্ট না হলেও স্ট্রেচারের ক্ষেত্রে হয়। খবাকৃতিদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। 

হুইলচেয়ারের মধ্যে দুই ক্যাটাগরি, স্ট্রেচার নিয়ে খেলার মধ্যে দুই ক্যাটাগরি, যারা খর্বকায় তাদের জন্য আরেকটা ক্যাটাগরিতে খেলা হয়। বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মোঃ মহসিন আজকের ব্যাডমিন্টনেও অংশ নিয়েছেন। প্যারা ব্যাডমিন্টন ও হুইল চেয়ার ব্যাডমিন্টন নিয়ে তার বক্তব্য, ‘আমরা আসলে ক্রীড়াপ্রেমী। ক্রিকেটের পাশাপাশি ব্যাডমিন্টনও খেলি। ২০ জন হুইল চেয়ার ব্যাডমিন্টনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দশ জন রয়েছেন ক্রিকেটার। পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক নেতৃত্ব থাকলে প্যারা ব্যাডমিন্টন অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’ 

আনন্দ নিয়ে খেললেও উডেন ফ্লোরে হুইল চেয়ার, এক হাতে স্ট্রেচার নিয়ে খেলা খানিকটা বিপদজনকও। খেলার ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে মহসিন বলেন, ‘স্ট্রেচারের চেয়ে হুইল চেয়ারে একটু ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে যাদের ব্যাকপেইন রয়েছে তারা ইনজুরিতে পড়লে সেটা মারাত্মক হতে পারে।’

টুর্নামেন্টের আয়োজক ও কমিটির প্রধান এনায়েত এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ডাক্তার সার্বক্ষণিক রেখেছি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে।’

এবারের প্রতিযোগিতায় ৬২ জন প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র তিন জন নারী। তিনজনই এসেছেন বাগেরহাটের ফকিরহাট থেকে । নবম শ্রেণীর ছাত্রী অর্পা মজুমদার ব্যাডমিন্টন খেলতে আসতে পেরে খুব খুশি, ‘ঢাকায় এসে এ রকম খেলতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমরা টুকুু স্যারের (শেখ জাহিদুল ইসলাম) অধীনে অনুশীলন করি গ্রামে।’ জাহিদুল ইসলাম ফকিরহাট থেকে এগার জন নিয়ে এই প্রতিযোগিতায় এসেছেন। 

ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিযোগীরা নিজ খরচেই এসেছেন। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন শুধু তাদেরকে ইনডোর স্টেডিয়ামে নিচ তলায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। শুধু খেলার আনন্দ দেওয়া নয়, আর্থিক বিষয়টিও ভাবনায় রয়েছে প্যারা ব্যাডমিন্টন কমিটির সভাপতি এনায়েতের, ‘ইভ্যালি আমাদের স্পন্সর করেছে। এর পাশাপাশি এশিয়ান ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের অনুদান রয়েছে। আমাদের ধারণা ছিল ৩০ জনের মতো প্রতিযোগী হবে। সেটা বেড়ে এখন ৬২। আমরা প্রতি ক্যাটাগরির চ্যাম্পিয়ন, রানার্স আপকে আর্থিক কিছু দেব। ’

২০১৯ সালে প্রথম প্যারা ব্যাডমিন্টন হয়েছিল। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারে অংশগ্রহণকারী সংখ্যা বেড়েছে অনেক।  

এজেড/এটি