ছবিটা যেন প্রতীকী। রোদের আলো যেন বিশ্ব আরচ্যারির স্পটলাইট, যা এসে ঠিকরে পড়ছে দিয়া সিদ্দিকীর চোখে-মুখে। দেশসেরা আরচ্যার রোমান সানাও অভিনন্দন জানাচ্ছেন তাকে/বিশ্ব আরচ্যারি

দিয়া সিদ্দিকী। বয়স মাত্র ১৭। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে নিজেকে বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন তিনি। বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের কোনো নারী ক্রীড়াবিদের রৌপ্য পদক জয়ের ঘটনা নেই। প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে তিনি সেই রেকর্ডের অধিকারী। রোমান সানাকে সঙ্গী করে সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ আরচ্যারিতে রিকার্ভ মিশ্র বিভাগে রৌপ্য জিতেছেন নীলফামারীর এই মেয়ে। মঙ্গলবার ভোরে সুইজারল্যান্ড থেকে ঢাকায় পৌঁছেছেন। টঙ্গীতে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে কোয়ারেন্টাইন করছেন। সুইজারল্যান্ড থেকে এসে মুঠোফোনে বিশ্বকাপ ও নিজের আরচ্যারির জীবন নিয়ে দিয়া সিদ্দিকী কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের- এর সঙ্গে।

ঢাকা পোস্ট: অভিনন্দন। বেশ সফল এক সফর শেষ করলেন। কেমন হলো বিশ্বকাপ আপনার দৃষ্টিতে ?

দিয়া: আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হয়েছে। রিকার্ভ মিশ্রে আমরা ফাইনাল খেলেছি। অন্য বিভাগগুলোতেও আমরা সবাই নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি। হয়তো সবার দৃষ্টি আমার আর রোমান ভাইয়ের দিকেই ছিল। সব মিলিয়ে আমি বলব আমাদের বিশ্বকাপ সফর ভালোই হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট: যখন ফাইনাল নিশ্চিত হলো তাৎক্ষণিক অনুভূতি যদি একটু বলতেন।

দিয়া: যখন ফাইনাল নিশ্চিত হলো তখন আমি কয়েক মিনিট একদম স্তম্ভিত ও শকড ছিলাম। একেবারে ‘ফ্রিজ’ যেটাকে বলে। চপল স্যার (সেক্রেটারি), কোচ জিয়া ভাই ও মার্টিন আমাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করে। এরপরও কয়েক মিনিট ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। আমি বিশ্বকাপের ফাইনালের অংশ হয়ে গেলাম।

ঢাকা পোস্ট: যেদিন ফাইনালে উঠলেন আর ফাইনাল খেলার আগের দিন রাতে কি ঘুমাতে পেরেছিলেন?

দিয়া: ফাইনালে উঠার পর থেকেই পরিবার, বিকেএসপির বন্ধু বান্ধব সবাই ফোন করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। সময় যে কিভাবে কেটে যাচ্ছিল বুঝতেই পারছিলাম না। ফাইনালের আগের দিন কোচ, চপল স্যার আমাদের রিলাক্স থাকতে বলেছিলেন আমি ও রোমান ভাই সেভাবেই থাকার চেষ্টা করেছি। 

ঢাকা পোস্ট: আপনি মাত্র ১৭ বছর। রোমান অনেক অভিজ্ঞ। ফাইনালে আপনি তুলনামূলক বেশি স্কোর করছিলেন রোমানের তুলনায়।

দিয়া: আসলে রোমান ভাই অনেক অভিজ্ঞ আমার তুলনায়। ফলে তার উপর চাপ এবং প্রত্যাশাটাও বেশি দেশবাসীর। হয়তো তিনি কিছুটা চাপে ছিলেন। আমি ছিলাম নির্ভার। তাই আমি একটু বেশি স্কোর করতে পেরেছি। 

লক্ষ্যভেদের আগে/বিশ্ব আরচ্যারি

ঢাকা পোস্ট: আপনার পারফরম্যান্সে রোমানের ভূমিকা কেমন?

দিয়া: অনেক ভূমিকা। তাকে দেখেই আমরা তরুণ প্রজন্মের আরচ্যাররা বেড়ে উঠছি। অনেকটা আরচ্যারিরই আইকন তিনি। আমি সৌভাগ্যবান যে তার সঙ্গে জুটি বাধতে পারছি। আমাকে সব সময় পরামর্শ এবং সহায়তা করেন। আমরা একে অপরকে খুব ভালো বুঝি। 

ঢাকা পোস্ট: আপনি এখনো বিকেএসপির ছাত্র। রোমান আনসারের হয়ে খেলে। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় আপনাদের জুটি গড়ার সুযোগ সেভাবে হয় না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনারা কিভাবে মানিয়ে নেন?

দিয়া: ২০১৯ সালে ঢাকায় আইএসএসএফে আমরা এক সঙ্গে খেলেছিলাম। তখন থেকেই আমাদের জুটির পথচলা শুরু। এরপর থাইল্যান্ডে এবং এশিয়া কাপেও আমরা একসঙ্গে খেলেছি। ফলে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে দারুণ। সেটার ফলাফলই এসেছে সুইজারল্যান্ডে। 

ঢাকা পোস্ট: টুর্নামেন্ট চলাকালে কখনো কি ভেবেছিলেন ফাইনালে উঠতে পারবেন?

দিয়া: আসলে সেভাবে আমরা দুই জনের কেউই ভাবিনি। ওই দিনটি আমাদের খুব ভালো গেছে। আমরা দুই জনই দারুণ ফর্মে ছিলাম। ভালো খেলছিলাম। আত্মবিশ্বাসীও ছিলাম ফলে জার্মান, কানাডার মতো আরচ্যারদের হারাতে পেরেছি। 

ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশের অনেক বড় ক্রীড়াবিদ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাবলীলভাবে বক্তব্য রাখতে পারেন না। আপনি ফাইনালের পর খুব সুন্দরভাবে বাতাসের সমস্যার কথাটা বললেন।

দিয়া: আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই ইংরেজী বিষয়টি পছন্দ করি। জানি না কতটা সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারি। তবে ইংরেজীতে আমার জড়তা নেই। কথা বলতেও পছন্দ করি। 

ঢাকা পোস্ট: ইংরেজীতে সাবলীল তাহলে তো আপনি শিক্ষার্থী হিসেবে অনেক মেধাবী!

দিয়া: মেধাবী কিনা সেটা জানি না। তবে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৪.৮৯ পেয়েছি। জিপিএ ফাইভ প্রত্যাশা ছিল। এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেতে চাই।

ঢাকা পোস্ট: বিকেএসপি থেকে ইন্টার মিডিয়েটে একমাত্র মুশফিকুর রহিম জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। বিশ্বকাপে রৌপ্য জেতার পর আপনার উপর চাপ বাড়বে। এই চাপ নিয়ে এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে না?

দিয়া: অন্য খেলায় যেমন অনেক শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। আরচ্যারিতে সেটা লাগে না। পড়াশোনা ও খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য খুব ভালো একটি ডিসিপ্লিন আরচ্যারি। আমার চেষ্টাটা আমি করে যাব। 

ঢাকা পোস্ট: অনেক মেয়েরা ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অ্যাথলেটিক্সে, হ্যান্ডবলে আকৃষ্ট হয়। আরচ্যারিতে আপনার আসার কারণটি কি?

দিয়া: আসলে সত্যি কথা বলতে আমার কাছে ফুটবল এবং ক্রিকেট কোনাটাই ভালো লাগে না। নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার একজন শিক্ষকই প্রথমে বলছিলেন তুমি আরচ্যারি খেল। তখন থেকেই মনে ধরে। আরচ্যারির খেলার আরেকটি কারণ আরচ্যারিতে ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যে সব খেলায় ব্যাথা সেগুলো আমার পছন্দ না। 

রৌপ্যজয়ের পর কোচ মার্টিন ফ্রেডেরিখের সঙ্গে/আরচ্যারি ফেডারেশন

ঢাকা পোস্ট: রোমান সানাকে এখন দেশের সেরা আরচ্যার বলা হয়। নিজেকে কি এখন সেরা নারী আরচ্যার বলবেন ?

দিয়া: না এখনো সেই সময় আসেনি। আমি তো মাত্র শুরু করলাম। আর অনেক দূর যেতে চাই। 

ঢাকা পোস্ট: সেই অনেক দূরের পথ চলায় কি আপনি রোমান সানার আলোয় আলোকিত হওয়ার বাইরে নিজেই রোমানকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন কি?

দিয়া: রোমান ভাই আরচ্যারিতে দীর্ঘদিন। এক যুগের বেশি সময়। সেই হিসেবে আমি মাত্র পথচলা শুরু করেছি। রোমান ভাইকে ছুঁতে আমার কমপক্ষে আরো এক দশক সময় লাগার কথা। এর কমে যদি পারি সেটা হবে ভাগ্য ও অন্য কিছু। 

রোমান সানার সঙ্গে বিশ্বকাপ পোডিয়ামে/আরচ্যারি ফেডারেশন

ঢাকা পোস্ট: রোমান টোকিও অলিম্পিকসে নিজের যোগ্যতায় খেলবেন। আপনার সামনে সম্ভাবনা রয়েছে। প্যারিসে কি এটা সম্ভব?

দিয়া: ব্যক্তিগতভাবে আমিও চাই রিকার্ভ মহিলা এককে একদিন নিজ যোগ্যতায় অলিম্পিক খেলব। তবে সেটা সময় সাপেক্ষ। আমার বর্তমান স্কোর থেকে অলিম্পিক নিশ্চিত স্কোরের খানিকটা দূরত্ব রয়েছে। তবে মিশ্র বিভাগের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। আমরা মিশ্রতে অলিম্পিকে কোটা প্লেস বা ওয়াইল্ড কার্ড পেলেও ভালো একটা কিছু করতে পারি। 

ঢাকা পোস্ট: তার মানে আপনি রোমানের সঙ্গে টোকিও অলিম্পিকে জুটি বাধার সুপ্ত বাসনা বুনছেন।

দিয়া: আমি যেহেতু এখন উনার সাথে খেলছি তাই কিছুটা স্বপ্নের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এরপরেও অনেক যদি কিন্তু রয়েছে। প্যারিসে আমার চেয়ে কেউ ভালো করতেই পারে। সেক্ষেত্রে তাদেরও সম্ভাবনা থাকবে। 

ঢাকা পোস্ট: অনেক ক্রীড়াবিদ ১৭-১৮ বছর বয়সে এত সুন্দর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারে না। আপনাকে ব্যতিক্রমই লাগছে। আপনার জীবনের লক্ষ্য কি?

দিয়া: আমি বাবা মায়ের বড় সন্তান। আমার ছোট দুই ভাই রয়েছে। আমার বাবা (নীলফামারীর সাংবাদিক) চান আমি যেন সেনাবাহিনীতে যাই। আমারও ইচ্ছে রয়েছে তবে সৈনিক পদে নয়, অফিসার হিসেবে পরীক্ষা দেব। সেনাবাহিনীতে যেতে না পারলে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। এইচএসসির পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগর) ভর্তি হতে চাই। এরপর শিক্ষকতা করব। এর মধ্যে আরচ্যারি তো চালিয়ে যাবই।

এজেড/এটি